ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিডনাইট হাসিনা সরকারের অধীনে কোনও ধরনের সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির। আর এ কারণেই দলটির নীতিনির্ধারকরা নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির ডাকা কোনও সংলাপে যাবে না বলে সভা-সেমিনারে স্পষ্ট করে বক্তব্য রাখছেন।
দলীয়ভাবে এ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গনমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সংলাপে না যাওয়ার। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
দলের প্রভাবশালী এক নেতা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি। যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ইতোমধ্যে বিএনপি জানিয়েছে, সেক্ষেত্রে আসন্ন সংলাপে অংশগ্রহণ করে সংলাপকে রাজনৈতিকভাবে পরিপুষ্ট করার কোনও সুযোগ নেই।
বিএনপির এই নেতার ভাষ্য—২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের যে কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে ছিলেন, তাদের অধিকাংশ এখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। দলীয় সরকারের ক্ষমতাকালে ও ওইসব কর্মকর্তার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ফলাফল কী হবে, তা বিএনপির অনুমেয়। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সংলাপে অংশ নিলে তা দলের নেতাকর্মী ও অন্যান্য বিরোধী দলের কাছেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
‘সরকার আর কত কতবার প্রতারণা করবে। একই প্রতারণা নতুন করে আবার শুরু করেছে। জনগণকে তারা এতটা বোকা কীভাবে ভাবে?’ গনমাধ্যমকে এ কথা বলছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চিঠি পেলে পার্টি সিদ্ধান্ত জানাবে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো—রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে বিএনপি যাবে না। আমি মনে করি, দলেরও এই সিদ্ধান্ত।’
কেন এমনটা মনে করেন—এ প্রশ্নের ব্যাখ্যায় ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘২০১৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে গিয়ে বর্তমান সর্বনিকৃষ্ট নির্বাচন কমিশন পেয়েছে। আর ২০১৮ সালে ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে গিয়ে নিকৃষ্ট সব নির্বাচন পেয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া এই সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচন করা যাবে না।’
সংলাপে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে আসছিল। জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সভায় গত ২ নভেম্বর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী নির্বাচনে এই রেজিমের অধীনে অংশগ্রহণ করবে না। শুধু তা-ই নয়, কোনও আলোচনায় বিএনপি যাবে না। কারণ, আমরা আলোচনা করেছি, অংশগ্রহণও করেছি। তার ফলাফল বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে।’ পরদিন স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এক সভায় বলেন, ‘সামনে যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার না হয়, এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বিএনপিসহ অন্যান্য দল নির্বাচনে যাবে না। এখানে সংলাপের কোনও প্রশ্নই আসে না।’
এরপর গত ২৩ নভেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসনের অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্য ছিল—‘আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট, এই সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা যাবো না। নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনও সংলাপে বিএনপি যাবে না।’
গত ১৪ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হলে আবারও আলোচনা শুরু হয় বিএনপিতে। এই আলোচনা চলে অনেকটাই ভেতরে-ভেতরে। সংলাপে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকায় এ প্রসঙ্গে বিএনপির এই আলাপ চলছে অনেকটাই গোপনে, নিজস্ব বলয়ে।
আগামী ২০ ডিসেম্বর থেকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি সংলাপ শুরু করবেন—সম্প্রতি এমন সংবাদে বিএনপির একটি পক্ষে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু—শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে কি অটল থাকবে বিএনপি? নাকি একাদশ জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়ার মতো এবারও শেষ মুহূর্তে সংলাপের টেবিলে বসবেন দলটির নেতারা।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এর আগেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন নিয়োগ দেবেন। এ লক্ষ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন রাষ্ট্রপতি। প্রথম দিন জাতীয় পার্টি আমন্ত্রণ পেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা জানা গেছে।
শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) বঙ্গভবনের একটি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে শেষ দিকে ডাক পাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
বিএনপির একটি প্রভাবশালী পক্ষ বলছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আসন্ন সংলাপ যেহেতু ‘রাজনৈতিক’ ভূমিকা রাখবে, সেক্ষেত্রে এই ‘রাজনীতি’ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বঙ্গভবন থেকে এখনও কোনও দলের কাছে আমন্ত্রণপত্র যায়নি। উপরন্তু, সংলাপে না গেলে কী পরিবর্তন আসবে? এই পরিবর্তনের অর্জন কী হবে? এসব প্রশ্নের এখনও বাকি, বলছেন বিএনপি নেতারা।
দলটির দায়িত্বশীল আরেকটি পক্ষের ইঙ্গিত—এই মুহূর্তে বিএনপির মূল কনসার্ন হচ্ছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি। সংলাপের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি সামনে আসবে কিনা, এ প্রসঙ্গটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যদিও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিএনপি প্রধানের বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার স্পষ্টত পরামর্শ রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও সংলাপের চিঠিই আসেনি। চিঠি আসার পর স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, বঙ্গভবনের চিঠি পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।