ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সরকারী তত্বাবধানে থাকা কয়েক কোটি মানুষের জন্ম নিবন্ধন সনদ গায়েব হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় বহু অভিভাবক নিজেদের জন্ম নিবন্ধন সনদ সার্ভারে দেখতে গিয়ে পাননি। এরপরই বিষয়টি সামনে আসে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় চার কোটি স্কুল শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল ইউনিক আইডি তৈরির কাজ চলছে, যার জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের জন্ম নিবন্ধন সনদের আবেদন করতে হলে আবার তাদের বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ অবস্থায় বহু অভিভাবক দেখছেন যে তাদের আগে নেওয়া জন্ম সনদ এখন আর সরকারি সার্ভারে প্রদর্শন করছে না।
বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন- আগে জন্ম নিবন্ধন করে সনদ নিয়েছেন এমন কয়েক কোটি মানুষকে এখন সম্পূর্ণ নতুন করে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। কারণ তাদের আগের নিবন্ধন গায়েব হয়ে গেছে।
তারা বলছেন, এসব ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন অনলাইনে আপডেট করা হয়নি এবং এখন নতুন সার্ভারে আর পুরনো তথ্য স্থানান্তর করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি স্কুল শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশের আবার একাধিক অনলাইন জন্ম নিবন্ধনের ঘটনাও বেরিয়ে এসেছে, যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে যারা ম্যানুয়ালি জন্ম সনদ নিয়েছেন তাদের মধ্যে যারা নিজ উদ্যোগে বা সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন অফিস থেকে অনলাইনে অ্যান্ট্রি করেননি তাদের জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য সার্ভারে আর নেই। তাদের এখন সম্পূর্ণ নতুন করে আবেদন করে জন্ম নিবন্ধন নিতে হবে বলেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন মোবারক।
বাংলাদেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত বলেন, ‘আগে যারা ম্যানুয়ালি জন্ম সনদ নিয়েছে তাদের তথ্যাদি অনলাইনে আপডেট করার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় ছিল। এগুলো নিবন্ধন অফিসগুলোরই করার কথা। ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেকটা হয়েছেও। কিন্তু পৌর এলাকাগুলোতে এটি হয়েছে খুব কম। যে কারণে বহু মানুষের তথ্য এখন আর অনলাইনে নেই। এখন আবার নতুন সার্ভারে পুরনো তথ্য স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। ফলে যাদেরটা বাদ পড়েছে তাদের নতুন করে জন্ম নিবন্ধন করাতে হবে।’
তবে এটি সংখ্যায় কত সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন তারিক হিকমত।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন মোবারক বলেন, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় পনেরো লাখ সনদের তথ্য আপলোড হয়েছে। তবে অনেকের তথ্যই আপলোড হয়নি বলে তাদের এখন নতুন করে নিবন্ধন করাতে হবে।
এদিকে ২০১৩ সালে সরকার আইন সংশোধন করে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়কে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব দেয়, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে। এর মধ্যে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের নতুন ওয়েবসাইট ও সার্ভার চালু করা হয়, যা ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু করে।
সে সময় গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুরোনো নিবন্ধিতদের জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করে নেওয়ার কথা বলা হলেও তা বেশিরভাগ মানুষের অগোচরেই থেকে যায়। ফলে এ আহ্বানে খুব বেশি সাড়া মেলেনি। আর যারা এটি করেনি বা নিবন্ধন কার্যালয়গুলোও নিজ থেকে যেগুলো আপলোড করেনি সার্ভারে সেগুলো আসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে গেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১১ সালের পর থেকে সব জন্ম নিবন্ধন অনলাইনেই হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের তথ্যগুলো অনলাইনে আপলোড করার সুযোগ ছিল।এরপর নতুন সার্ভার আসে কিন্তু সেটিতে আর পুরনো তথ্য আপলোড করার সুযোগ না থাকায় ২০১১ সালের আগে করা বহু নিবন্ধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে গায়েব হয়ে যায়। অর্থাৎ সেগুলো অনলাইনেই কখনো আসেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে স্কুলে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি পরীক্ষার সময়েও জন্ম সনদ দিতে হয়।
রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস বলছে, সরকার দেশের প্রায় চার কোটি স্কুল শিক্ষার্থীর জন্য একটি ইউনিক আইডি খোলার কাজ শুরু করেছে।
হিকমত বলেন, ‘এটি করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর স্কুলে ভর্তি আর পিএসসির সময়ে দেওয়া জন্ম সনদের মিল নেই। অর্থাৎ তাদের নামে দুটি করে সনদ নিয়েছেন তাদের অভিভাবকরা। আমরা এটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছি।’
আবার শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার জন্য সুরক্ষা অ্যাপে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্যও জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেখানে জন্মসনদ দিতে গিয়ে অনেক অভিভাবক দেখছেন যে ২০১১ সালের আগে নেওয়া জন্মসনদ জাতীয় সার্ভারে নেই।
কাজী আশরাফুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘তার, তার বাবা, মা ও বোনের জন্মসনদ করানো হয়েছিল ২০০৭ সালে কিন্তু পরে তাদেরকে আবার ২০১৯ সালে জন্ম নিবন্ধন করাতে হয়েছে।’
শফিকুল ইসলাম নামের একজন সরকারি কর্মকর্তার দুই সন্তান ঢাকার ভিকারুন্নিসা স্কুলে পড়ে। সেখানে কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে তিনি সম্প্রতি দেখেন যে তার জন্মনিবন্ধন অনলাইনে নেই অথচ তিনি ২০১০ সালে মিরপুরে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড অফিস থেকে সেটি করিয়েছিলেন।
রেহানা খানম ঢাকার মোহাম্মদপুরের অধিবাসী। কয়েকদিন আগে মেয়ের জন্ম সনদের আবেদন করতে গিয়ে নিজের জন্মসনদ অনলাইনে পাননি তিনি। বলেন, ‘আমার জন্ম নিবন্ধন গ্রামের বাড়িতে। সেখান থেকে ঠিক করিয়ে আনতে হয়েছে। এটা হয়রানি ছাড়া আর কিছু না।’
ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন মোবারক অবশ্য বলেন, ‘২০১০ সাল পর্যন্ত বহু মানুষের জন্মসনদের তথ্য অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে তবে অনেকেরটাই শেষ করা যায়নি। তবে এখনকার সার্ভারে পুরনোটা আর দেওয়া যাবে না। তাই যাদেরগুলো বাদ পড়েছে তাদের নতুন করেই করতে হবে।’
কর্মকর্তাদের ধারণা, সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ কোটি জন্মনিবন্ধন একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিস থেকে সম্প্রতি একটি প্রস্তাব গেছে মন্ত্রণালয়ে যেখানে বলা হয়েছে যারা আগে জন্ম সনদ নিয়ে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন কাজে সেই নিবন্ধন নাম্বার নতুন সনদেও উল্লেখ করার জন্য। মূলত একই ব্যক্তির যাতে একাধিক নিবন্ধন না হয় সেজন্যই এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে যাদের তথ্য অনলাইনে আসেনি বা যারা নিজ উদ্যোগে এটি করিয়ে নেননি তাদের জন্ম সনদ পেতে হলে এখন সম্পূর্ণভাবে নতুন করে আবেদন করে তা নিতে হবে বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।