ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন ও সম্পর্কের প্রতিফলন হিসেবে গত সোমবার দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়েছে। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি জে ব্লিনকেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন নেতৃত্ব দেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি জে ব্লিনকেন বাংলাদেশে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি (জনগণের ভোটাধিকার), মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি এসবের গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। মুখপাত্র নেড প্রাইসকে উদ্বৃত করে গত সোমবার অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বৈঠকে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানান, সহসাই র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠছে না। এটার প্রসেস রয়েছে। আসলে র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সুইচ অন অফের মতো নয়; যে টিপে দিলাম উঠে গেল।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ওই বৈঠকের উদ্বোধনী সেশন বা দুই মন্ত্রীর সুচনা বক্তব্য আগেই প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে যে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে মন্ত্রী মোমেন গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেছেন। অতপর স্টেট ডিপার্টমেন্টর তরফে মুখপাত্রকে উদ্বৃত করে বিবৃতিটি প্রচার করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন ও সম্পর্কের প্রতিফলন হিসেবে সেক্রেটারি অফ স্টেট এন্টনি জে. ব্লিনকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেক্রেটারি অব স্টেট ব্লিনঙ্কেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সম্পর্কের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে ফুলব্রাইট বিনিময়সহ দুই দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠাসহ গত অর্ধ শতাব্দীতে পারস্পরিক সহযোগিতার যেসব প্রতিফলন ছিল তা নিয়ে কথা বলেছেন। উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিদ্যমান সহযোগিতা, গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেনঅন্যদিকে ওয়াশিংটনের বৈঠকে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা থেকে মুক্ত সম্ভবনাময় অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে আরও মার্কিন বিনিয়োগ চেয়েছে ঢাকা। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে হওয়া প্রায় ৪৫ মিনিটের বৈঠকে স্থান পায় ঢাকা ও ওয়াশিংটনের ৫০ বছরের সম্পর্কের পর্যালোচনা, সামনের দিনগুলোতে একসঙ্গে পথ চলা, বিনিয়োগ, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বঙ্গুবন্ধুর হত্যাকারী রাশেদকে ফেরত, রোহিঙ্গা ইস্যু, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা, কোভিড সহযোগিতাসহ শ্রম অধিকার নিয়ে আলোচনা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আরও জোরদারে একসঙ্গে কাজ করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র আনন্দিত। আমরা পরবর্তী ৫০ বছরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
বাংলাদেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ সত্যিই অনেক অর্জন করেছে। আমাদের চলার পথে যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে সঙ্গে ছিল। সবসময় মার্কিন সহযোগিতা আমাদের সঙ্গে ছিল। বাংলাদেশ এখন আর সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে জ্বালানি খাতের বাইরেও মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানোর সময় এসেছে। আমরা ওয়াশিংটনের সঙ্গে আরও উন্নত ও দৃঢ় সম্পর্কের অপেক্ষায় রয়েছি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। সেখানে আলোচনার বিষয়ে মোমেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র অবকাঠামো খাতে তেমনভাবে বিনিয়োগ করেনি। আমি ওনাদের অনুরোধ করেছি এখানে যুক্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ও আইটি খাতে তাদের বিনিয়োগের আহ্বান করেছি। টিকা সহায়তা করায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি।
ড. মোমেন বলেন, র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, এটার একটি প্রসেস রয়েছে। সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আসলে র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সুইচ অন অফের মতো নয়। এটা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) চাইলেও হঠাৎ করে প্রত্যহার করতে পারবে না। এটার একটির প্রসেস রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় জিনিসের প্রসেস আছে। ওই কমিটির সদস্যদেরকে সন্তুষ্ট করতে হবে আমাদের। এটা আমাদের দেশের মতো নয় যে, হ্যাঁ বললেই হ্যাঁ হয়ে যাবে। যেমন এখানে ট্যারিফ রেট কমাতে হলে ২৩ টা কমিটির অনুমোদন লাগে। তারপর প্রেসিডেন্ট অনুমোদন করেন। এখানে সব কিছু একটি প্রসেসের মধ্যে দিয়ে হয়।
শ্রম অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, তারা বাংলাদেশের শ্রম অধিকার আরও উন্নত করার সুপারিশ করেছেন। আমরা তাদের শ্রম অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশে যেসব উন্নতি করেছে সেসব বিষয় সম্পর্কে জানিয়েছি। তাদের বলেছি, আমরা আইএলও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পরামর্শ করে শ্রম অধিকার খাতের উন্নয়ন করছি। জবাবে ব্লিনঙ্কেন বলেছেন, আইএলও’র সঙ্গে কাজ করলেই সেটিকে আমরা মোটামুটিভাবে মানদণ্ড হিসেবে মেনে নেই। তিনি বলেন, বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীর বিষয়টি তুলেছি। আমি বলেছি, একজন খুনিকে আশ্রয় দেওয়াকে আমেরিকান জনগণ পছন্দ করবে না। এটা নিয়ে আপনাদের চিন্তা করা উচিত। এ প্রক্রিয়াটি দ্রুত শেষ করার কথা বলেছি।
ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, অবাধ, উন্মুক্ত, অন্তর্মুখী এবং নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক চাই। আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছেন সেগুলো ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরেন দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস।
এ সময় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নাহিম রাজ্জাক প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।