ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের বাজারে মার্কিন ডলারের দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। হু হু করে বাড়ছে দাম। কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে ডালারের দাম গতকাল মঙ্গলবার ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ব্যাংক পাড়া মতিঝিল, পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো আজ খুচরা ডলার ১০০ টাকা থেকে ১০২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একদিন আগেও এ দর ছিল ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা। মঙ্গলবার বিকেলে পাইনিওর এক্সচেঞ্জ হাউজে ডলারের দাম জানতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মী বলেন, আজকে রেট ১০২ টাকা। তবে এখন নিতে চাইলে এক টাকা কম রাখা যাবে। এর নিচে দেয়া যাবে না। এতো দাম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতকাল ৯৭/৯৮ টাকা বিক্রি করেছি আজকে ১০২ টাকা উঠেছে, কাল আরও বাড়বে। কারণ ডলার পাচ্ছি না। চাহিদা আছে ডলার নেই। মতিঝিলের আরেক ডলার ব্যবসায়ী আব্দুল জাব্বার বলেন, আজকে ১০১ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করছি। মানুষ বিদেশ যাচ্ছে। এখন নগদ ডলারের প্রচুর চাহিদা। ব্যাংকগুলোতেই ডলারের সংকট। এখন প্রতিদিনই দুই-তিন টাকা করে বাড়ছে। সামনে হজ মৌসুম আসছে, আরও দাম বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ সোমবার (১৬ মে) ডলারের দর বেঁধে দিয়েছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু তাদের বেঁধে দেয়া এ রেট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও মানছে না। এখন ব্যাংকে এলসি করতে গেলে ডলারের বিপরীতে নেয়া হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৩ টাকা। আবার কোনো কোনো ব্যাংক ৯৫/৯৬ টাকাও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া রেটের চেয়ে বাজারে বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছেও এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। তবে আমাদের রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি বেশি, এ কারণে ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। যখনই প্রয়োজন আরও ডলার সরবরাহ করা হবে। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে একদিকে ব্যাপক হারে আমদানির চাপ বেড়েছে। ফলে আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। কিন্তু সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়েনি। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা ও খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলার। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায় ডলারের দাম। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি এটি বেড়ে ৮৬ টাকা হয়। গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এপ্রিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা, ১০ মে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা এবং গতকাল (১৬ মে) ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায় ডলারের মূল্য। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ গত ৯ মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে দুই টাকা ৭০ পয়সা।
রেকর্ড ডলার বিক্রি : চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ মে পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫০২ কোটি (৫.০২ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সবমিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে : এদিকে আমদানির চাপে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) ওপর চাপ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। দেশের ওই রিজার্ভ গত ১১ মে (বুধবার) ৪১.৯৩ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৯৩ কোটিতে নেমে এসেছে।
রফতানির চেয়ে আমদানি বেড়েছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রফতানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আলোচিত ৯ মাসে রফতানি থেকে দেশ আয় করেছে তিন হাজার ৬৬২ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রফতানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্স : জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। যা ছিল আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।