ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-২০২২ বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে ইএমকে সেন্টারে মঙ্গলবার বক্তব্য রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। এতে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানান। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে দেশের জনগণকে তাদের সরকার বেছে নেয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। এখানে তার বক্তব্যের হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো:
এখানে উপস্থিত সম্পাদক ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে আমার একটি সাধারণ স্বাগত বার্তা- ধন্যবাদ আপনাদেরকে। উত্তম পেশায় যুক্ত আছেন আপনারা। বিশ্বজুড়ে এই কাজটি ক্রমেই কঠিন ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলের প্রতি সম্মান জানিয়ে নীরবতা পালন করেছি আমরা। পশ্চিমতীরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সেনারা যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার বিষাদময় ও নৃশংসতা সম্পর্কে কথা বলার যদি সাহস দেখান রাশিয়ান কোনো সাংবাদিক, তাহলে তাকে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ বিপদের।
আর এখানে বাংলাদেশে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ও কক্সবাজারে আলাদা হামলা চালিয়ে আহত করা হয়েছে অনেক সাংবাদিককে।
সংক্ষেপে বলতে হয়, সাংবাদিক হতে সাহস লাগে।
এখানে সংবাদ বিষয়ক পেশাদার হিসেবে যারা উপস্থিত আছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলেন মতিউর রহমান ও মতিউর রহমান চৌধুরী।
সত্যকে চেপে যাওয়ার ভয়ঙ্কর চাপের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও এসব সম্পাদকের প্রতিজন তাদের সম্পাদকীয় বাছাইয়ে অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। আমি জানি আরও অনেক সাহসী সাংবাদিক আছেন এখানে। তাদের অনেকে আছেন এই রুমের মধ্যে। অনেকে তাদের কাহিনী আমার সঙ্গে শেয়ার করেছেন।
অনুগ্রহ করে আসুন আমার সঙ্গে এসব সাহসী সাংবাদিককে করতালি দিয়ে প্রশংসিত করি।
সাহসী সাংবাদিকরা প্রতিদিন আমাদের সামনে যা তুলে ধরেন তার জন্য তাদের প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ, মুক্ত সমাজে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা হলেন সত্যের অভিভাবক, যারা জনগণকে শিক্ষিত করে তোলেন এবং শক্তিধর ব্যক্তিদের জবাবদিহিতায় নিয়ে আসেন।
যেকোনো প্রাণবন্ত মুক্ত সমাজের জন্য এটাই সাংবাদিকদেরকে চাবিকাঠি করে তোলে। অবাধে তাদের কাজ করার সক্ষমতা এবং সত্যকে আলোতে নিয়ে আসাকে অবশ্যই লালন ও সুরক্ষিত করতে হবে।
স্টেট অব প্রেস ফ্রিডমঃ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ধারণাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, আমাদের বিল অব রাইটসের একেবারে ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে পরিণত হয়েছিল তা। অবশ্যই এর অর্থ এই নয় যে, যখন অবাধ সংবাদ মাধ্যমের কথা সামনে আসবে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একেবারে যথার্থ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৪২তম। হ্যাঁ, এ অবস্থান শীর্ষ শতকরা ২৫ ভাগের মধ্যে। কিন্তু শীর্ষ স্থান থেকে অনেকটা দূরে এ অবস্থান। খোলামনে বলছি, আরও ভালো করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের।
একই ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। আগের বছরের চেয়ে এই অবস্থান ১০ ধাপ নিচে। বাংলাদেশের এত কম স্কোর করার একটি কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনকে বলা হয়েছে ‘সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত আইনগুলোর অন্যতম’।
আমাদের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট এবং সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে উভয় ক্ষেত্রেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। আপনারা সবাই যেমন জানেন, কোনো সাংবাদিক যদি এমন কিছু প্রকাশ করেন, যাকে সরকার মনে করবে মিথ্যা, আক্রমণাত্মক, অবমাননাকর ও মানহানিকর, তাহলে ওই সাংবাদিককে ক্রিমিনাল হিসেবে বিচার করার হুমকি আছে এই আইনে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ‘রেজ্যুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফরমস’-এর খসড়া এবং ‘ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্টের’ খসড়া নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। এখনো এই খসড়ার কোনোটিই চূড়ান্ত করা হয়নি। আমাদের আশঙ্কা এতে এমন সব বিধি আছে, যা ব্যবহার হতে পারে সাংবাদিক ও অন্য যারা নিজেদের মতপ্রকাশ করতে উদগ্রিব- তাদেরকে আরও ভয় দেখানোর জন্য।
নির্বাচনঃ
সাংবাদিকরা প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন যখন, তখন তারা নির্বাচনে আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বেশি সংখ্যক খবর দেখতে পাচ্ছি আমরা সবাই। বাংলাদেশের নির্বাচন বা যেকোনো স্থানের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো- আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে দেশের জনগণকে তাদের সরকার বেছে নেয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু যখন সাংবাদিক ও মিডিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয় আসে তখন প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কি? জর্জিয়াভিত্তিক কার্টার সেন্টার- দ্য আটলান্টা হলো নির্বাচন বিষয়ে একটি সুপরিচিত কর্তৃপক্ষ। তারা বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের মানদণ্ড প্রকাশ করেছে।
সংবাদভিত্তিক মিডিয়া সংশ্লিষ্ট যে মানদণ্ড তারা দিয়েছে তা হলো:
১. সম্পাদকীয় নিরপেক্ষতা সুরক্ষিত থাকতে হবে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত থাকতে হবে।
২. সরকারের সমালোচনা করতে পারবে মিডিয়া।
৩. অন্যদের দেয়া অসত্য বিবৃতি প্রকাশের জন্য মিডিয়া দায়ী থাকবে না।
৪. মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করতে, জনবিতর্কের শ্বাসরোধ করতে এবং সরকারের সমালোচকদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে মানহানির অভিযোগ ব্যবহার করা যাবে না।
৫. হয়রানি এবং সহিংসতা থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষিত রাখতে হবে।
আমি এখানে খুব বেশি আশা করি এই পাঁচটি মূলনীতি নির্বাচনী মওসুমজুড়ে এবং তার পরেও সমুন্নত রাখা হবে।
দুটি কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। প্রথমত, মুক্ত সংবাদ মাধ্যমকে সুরক্ষা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে আমাদের সবার। একই সঙ্গে ভয়ভীতি, হয়রানি ও সেন্সরশিপ ছাড়া তথ্য অনুসন্ধান করে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের রিপোর্ট করার সুযোগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। দ্বিতীয়ত, একটি বৈধ ও মুক্ত গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মুক্ত সংবাদ মাধ্যম।
ধন্যবাদ আপনাদেরকে।