দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মেজর জিয়াউর রহমান একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অসম্পূর্ণ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকেরান সেক্টরে মেজর জিয়ার অসীম সাহসিকতার নিদর্শন থাকলেও তার নাম বেশি আলোচনায় আসে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই নির্বাচনের ফলাফল দেখে তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার ভয়ই পেয়েছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। তাদের ভয় ছিল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যদি প্রধানমন্ত্রী হন এবং দেশ শাসন করেন, তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেটা মেনে নেবে না। নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, শেখ মুজিবই হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি সরকার গঠনে ব্যর্থ হলেন। নানা টালবাহানায় করা হচ্ছে কালক্ষেপণ। প্রথম দফা আলোচনার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশাল প্রতিনিধি নিয়ে ঢাকা আসলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। ফিরে গিয়ে কান ভারী করলেন ইয়াহিয়া খানের। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা আসলো ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের।
শেখ মুজিব বললেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করা হবে পরবর্তী কর্মসূচি। তবে ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলায় পাক শাসনব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালত সবকিছু চলছে শেখ মুজিবের কথায়। রাস্তা-ঘাট জনতার দখলে। বারুদের মত তেতে আছে গোটা পূর্ববাংলা। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে ইয়াহিয়া খান সেই বারুদে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেন।
আসলো সেই কাক্সিক্ষত ৭ মার্চ। কানায় কানায় পূর্ণ রেসকোর্স ময়দান। ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি যে বার্তা দিলেন সে ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি সেনাপ্রধান এ কে খন্দকারের লেখা গ্রন্থ ‘১৯৭১ : ভেতরে ও বাইরে’-এর সাহায্য নিতে পারি। ওই ভাষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া ইয়াহিয়া খান নিজেও ওই ধরনের ঘোষণা না দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকায় ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল তা আমি মনে করি না।’ (পৃঃ ৩২)। এরপর ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ১৬ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত শেখ মুজিবের সাথে বৈঠক করলেন। ২১ মার্চ আসলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২২ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনা হলো দুটি স্তরে। একটি হলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান, আরেকটি হলো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে। সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মুশতাক, ক্যাপটেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও ড. কামাল হোসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন পীরজাদা, কর্নওয়ালিস, কর্ণেল হাসান ও একে ব্রোহি। ২৪ মার্চ তারিখ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচনায় একটি কনফেডারেশনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান এতটুকু মেনে নিলেই টিকে যায় পাকিস্তান। ২৫ মার্চ শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। এজন্য শেখ মুজিব অপেক্ষায় ছিলেন কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া খান। ফলে কাক্সিক্ষত সেই বৈঠক আর কখনো হয়নি।
এ কথাগুলো বলা হলো এ কারণে যে শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত চেয়েছিলেন আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছাতে। সেজন্য তিনি অন্য কোনো নেতার কথায় কর্তপাত না করে নিজ বাসভবনে থেকে যান গ্রেফতার হওয়ার জন্য। তবে শেখ মুজিবের এই গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একে খন্দকার তার গ্রন্থে, ‘২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুসহ শত শত লোকের নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল। ২৫ মার্চ রাতে সুযোগটি গ্রহণ না করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গ্রেফতারকে নিয়ে বহু আলোচনা ও সমালোচনা হয়।’ একে খন্দকার আরও বলছেন, ওই রাতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে আত্মগোপন করার কথা বলেন, অথচ তিনি কোথায় যাবেন, সে কথা কাউকে বলেননি। যদি তিনি গ্রেফতার হন, তাহলে দলের নেতৃত্ব কী হবে, তাও তিনি কাউকে বলেননি।’ পৃষ্ঠা ৪৩। এরপরে আসে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গ। শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ গ্রন্থের ১৪৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পূর্বাভাস পর্যন্ত দিলেন না, তাকে এ সম্পর্কে কিছু জানালেন না। টেপরেকর্ডারেও কোনো নির্দেশ দিতে রাজি হলেন না। আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেশবাসী ও বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেবার কথা ছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাতে তিনি সাড়া দিলেন না। ২৫ মার্চ রাতে তার বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদ যে লিখিত স্বাধীনতা ঘোষণার খসড়াটি নিয়ে আসেন তাতেও স্বাক্ষর দানে অপারগতা জানালেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা এড়ানোর জন্য। ব্যাপারটি বিস্ময়কর। অথচ সে রাতে পাকিস্তান বাহিনী যে ক্র্যাকডাউন করবে তা তিনি জানতেন।’ সবকিছু জেনে বুঝে শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে স্যুটকেস রেডি করে বসেছিলেন গ্রেফতার হওয়ার জন্য অথবা আত্মসমর্পণ করার জন্য। নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে যেতে বললেন। কিন্তু তার অবর্তমানে কে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন সে সিদ্ধান্ত তিনি দিয়ে গেলেন না। অর্থাৎ শেখ মুজিবের অবর্তমানে বাংলাদেশ নেতৃত্ব শূন্য দেশ।
দুই.
২৫ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার রাজনৈতিক নেতারা যখন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন ঠিক তখন চট্টগ্রামে একজন সেনা কর্মকর্তা নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘোষণা করলেন ‘উই রিভোল্ট’। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও তিনি বুক চেতিয়ে দাঁড়ালেন পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে।
পরের দিন ২৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমাদের যুদ্ধ শুরুর কথা দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানোর জন্য হাজির হলেন কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়া আমার কাছে কাগজ কলম চাইলেন। আমি তার হাতে একটি কলম এবং খাতা তুলে দিলাম। তিনি একের পর এক লিখছেন আর কাটছেন। ১৫ মিনিটের ভাষণ লিখতে সময় লাগলো প্রায় দু ঘন্টা। এক সময় বললেন, লেখা শেষ। আপনারা রেডি করুন।” মেজর জিয়া ঘোষণা করলেন, ‘আই মেজর জিয়া হিয়ার বাই ডিক্লেয়ার দ্যা ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ। উই আর নাউ ইনগেজড দ্যা ফাইটিং অব দ্যা ওয়্যার অব ইনডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ। আই অ্যাপিল টু অল বেঙ্গলিজ অ্যাট হোম এন্ড এ্যাবরড টু এক্সটেন্ড সাপোর্ট অ্যান্ড জয়েন আস ইন আওয়ার ওয়্যার অব ইনডিপেনডেন্স। আই অ্যাপিল টু অল পিস লাভিং কান্ট্রিজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড টু এক্সটেন্ড রিকগনিশন টু দিজ নিউ কান্ট্রি অব বাংলাদেশ। আন্ডার দিজ সারকামস্টান্সেস আই ডিক্লেয়ার মাইসেলফ প্রভিশনাল হেড অব বাংলাদেশ। জয় বাংলা।(I Major Zia here to declare the independence of Bangladesh. We are now engaged in fighting the war of independence of Bangladesh. I appeal to all Bengalis at home and abroad to extend support and join us in our war of independence. I appeal to all peace-loving countries of the world to extend recognition to this new country of Bangladesh. Under these circumstances, I declare myself the Provisional Head of Bangladesh. Jai Bangla)’ এই ‘প্রভিন্সিয়াল হেড অব বাংলাদেশ’ কথাটাকে আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকুল ইসলাম ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটা মেজর জিয়া অতি উৎসাহে বলে ফেলেছেন।
যাহোক মেজর জিয়ার এই স্বাধীনতার ঘোষণা ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে। স্ফুলিঙ্গের মতো শিহরণ জাগালো দিশা হারা, পথ হারা জাতির হৃদয়ে। এই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের অবসান ঘটানোর জন্য বাংলার জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করে প্রবল প্রতিরোধ।
*২৮ মার্চ দুপুরে রেডিওতে মেজর জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘মেজর জিয়ার আহবান বেসামরিক, সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণির মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে।’ স্বাধীনতার দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড পৃষ্ঠা ৬৩।
*১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন বাকশাল নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের মুখ থেকে শুনতে পাই, ‘২৭ মার্চ সকালে চায়না বিল্ডিংয়ের কাছে আমার বন্ধু আতিয়ারের বাসায় গেলাম। তার কাছ থেকে একটা লুঙ্গি আর একটা হাফ শার্ট নিয়ে রওনা হলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরায়। নদী পার হয়েই রওনা হলাম গগনদের বাড়িতে। পথে দেখা হলো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। পরে আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে এক লোক, তার ঘাড়ে ইয়া বড় এক ট্রানজিস্টর। আমরা যাব বালাদিয়া। নৌকায় শুনলাম হঠাৎ কোনো বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হচ্ছে ‘আই মেজর জিয়াউর রহমান ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ। আমরা তো অবাক। বলে কি? পরে আবার শুনেছি জিয়া বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ মেঘনায় প্রকাশিত আবদুর রাজ্জাকের এই সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিল, ‘বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস প্রস্তাব বিবেচনা করছিলেন।’
*ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি যুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয় ২৬ মার্চ মেজর জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার পর।’ মেজর জিয়ার ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলা যাবে না, এটাকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ বলতে হবে বলে নানামুখী তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তাদের দাবি শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন সেটাই মেজর জিয়া পাঠ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাত সাড়ে আটটায় সাংবাদিক সম্মেলন করে ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছেন। এর সপক্ষে দুটি শক্ত দলিল হাজির করা যেতে পারে, যার বিরোধিতা এ পর্যন্ত হয়নি। ১. শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ গ্রন্থের ৫৯ পৃষ্ঠায় ‘তিনি (শেখ মুজিব) আব্বুকে বললেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশুদিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।
২. ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আমি জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর শেষ বক্তব্যের খসড়া তৈরি করতে ব্যস্ত। আমার খসড়া প্রস্তুত হলো। বঙ্গবন্ধু একটু দেখে ঠিকঠাক করে দিলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সামনে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৬। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠবে, গবেষণা হবে, সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসবেই, যা কিনা আদালতের রায় দিয়ে রদ করা যাবে না।
তিন.
মেজর জিয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হলো স্বাধীনতার যুদ্ধ। ঘুরে দাঁড়ালো গোটা জাতি। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক সর্বস্তরের মানুষ দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে যুদ্ধ করেছে। সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমরা মেজর জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে বুঝতে পারি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পরে আমাদের করণীয় ঠিক করতে ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় একত্রিত হই।’ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ জন সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ওই বৈঠকে প্রথমে মুক্তিবাহিনীকে ভাগ করা হয় চারটি সেক্টরে। চার সেনা কর্মকর্তাকে এসব সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে চার সেক্টরের কাজের সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
বৈঠকে অংশ নেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী এমএনএ, আব্দুর রব, লে. কর্নেল সালেহ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর সাফায়াত জামিল, মেজর সি আর দত্ত, ক্যাপ্টেন মো. নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, লে. সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম, লে. হেলাল মুর্শেদ খান, লে. নাসির উদ্দিন, লে. মাহবুব, লে. আনিস, লে. সেলিম, ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে, এমএনএ মোস্তফা আলী ও মানিক চৌধুরী, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী ও এনামুল হক মোস্তফা শহীদ প্রমুখ।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোটি ৪ এপ্রিল থেকে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর এবং পরে ৩ ও ৪ নং সেক্টর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১ নং সেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিকুল ইসলাম। পরে জুলাই মাসে জেড ফোর্স গঠন করে তার অধিনায়ক হন মেজর জিয়া। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো নতুন দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত। মেজর জিয়া পান মুক্তিযুদ্ধের সর্ব্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘বীর উত্তম’।
কিন্তু এই নয় মাস সুখে কাটেনি জিয়া পরিবারের সদস্য স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং পুত্র তারেক রহমান পিনো ও আরাফাত রহমান কোকোর। রণাঙ্গনে থেকে একবার কৌশল করে ১৬ মে তাদের চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে পাঠাতে সক্ষম হন তিনি। সেখান থেকে ঢাকার শান্তিবাগে। মেজর জিয়ার বিদ্রোহ ঘোষণার কারণে শান্তিবাগ থেকে আটক করা হয় বেগম জিয়া, শিশু পিনো ও কোকোকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম কারারুদ্ধ হতে হয় তাদের। যুদ্ধের এই নয় মাসের মধ্যে ১৬৭ দিন বন্দিজীবন কাটান তারা।
চার.
তৃতীয়বার মেজর জিয়া বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবের মাধ্যমে। সেনাপ্রধানের পদ থেকে তাকে সরিয়ে ৩ নভেম্বর দৃশ্যপটে হাজির হন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেই প্রথম সুযোগে বন্দি করেন জিয়াকে। একই সময়ে গৃহবন্দি হন স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান পিনো এবং আরাফাত রহমান কোকো। এটা তাদের জন্য দ্বিতীয়বার কারাজীবন। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সেনা সদর ও বঙ্গভবন দখলে নিলেও সেপাহীরা থাকে নীরব। টানা চারদিন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করে দেশে। সেনা ছাউনিতে চাপা উত্তেজনা। ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে সেপাহীরা। আর একাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কর্ণেল তাহের। ভেতরে সেপাহী বাইরে জনতা। সিপাহী-জনতার বিপ্লবে মুক্ত হন জেনারেল জিয়া। রেডিও টিভিতে যখন তার কন্ঠে ভেসে এলো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, ‘আমি জেনারেল জিয়া বলছি।’ তখন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে উল্লাসে সেøøাগানে প্রাণঢালা সমর্থন জানায় জিয়াকে। আমাদের জাতীয় জীবনের ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালের দুটি চরম সংকটময় মুহূর্তে শহীদ জিয়া সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে জন্য তাকে এদেশের কোটি কোটি মানুষ হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে তার প্রশ্নাতীত সমর্থন ও ভালবাসা তাকে আসীন করেছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাদপীঠে।
রণাঙ্গনে সফল যোদ্ধা দেশ পরিচালনায়ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন মেজর জেনারেল জিয়া। প্রেসিডেন্ট হিসাবে জিয়াউর রহমানের সাফল্য আকাশ ছোঁয়া। তলাবিহীন ঝুড়ির অর্থনীতি তিনি টেনে তুলে সমৃদ্ধির কাতারে নিয়ে গেলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি নিজকে আঞ্চলিক নেতা থেকে বিশ্বনেতৃত্বের কাতারে স্থাপন করতে সক্ষম হলেন। সে এক বিরাট ইতিহাস। আজকের এই মহান বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে সেই নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, যার জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য।