ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ঢাকা সফরে ব্যস্ত সময় পার করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত (উপদেষ্টা) রিয়ার এডমিরাল আইলিন লাউবাচার। গত ৭ই জানুয়ারি একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা হোয়াইট হাউসের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা গত দু’দিন ঢাকা এবং কক্সবাজারে সিরিজ বৈঠকে কাটিয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে পৃথক বৈঠক। এ ছাড়া তিনি একাধিক মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে জো বাইডেনের উপদেষ্টা বলেন, মানবাধিকার, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিশ্বের দেশে দেশে সংগ্রামরত মানুষকে সমর্থন দিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সমর্থনে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে কথা বলতে দ্বিধা করবেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আইলিন বলেন, বিশ্বজুড়ে শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, একে অপরের সঙ্গে সততার ভিত্তিতে কথা বলাকে আমরা শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নিদর্শন বলে মনে করি। নিজেদের দেশেও আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করার মতো জটিল কাজ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হচ্ছে জানিয়ে হোয়াইট হাউসের প্রতিনিধি বলেন, এ ক্ষেত্রে কীভাবে আরও উন্নতি করা যায় তাতেই ওয়াশিংটনের পূর্ণ মনোযোগ। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে এসব বিষয়ে গঠনমূলক পরামর্শ পেতে যুক্তরাষ্ট্র সচেতন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের পরামর্শ আমরা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেই। এটাকে কোনো অবস্থাতেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করি না।
তিনি আরও বলেন, যখন বিদেশি সরকার, ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর মন্তব্য, নিরীক্ষণ বা সমালোচনা করে তখনো এটাকে ওয়াশিংটন হস্তক্ষেপ বলে পাল্টা সমালোচনা করে না। মার্কিন প্রতিনিধি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে গণতান্ত্রিক শাসন ক্রমাগতভাবে মানুষের মর্যাদা রক্ষায় কর্তৃত্ববাদকে ছাড়িয়ে যায়। আরও সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীল সমাজ বিনির্মাণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে তা শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে।
পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে যা আলোচনা হয়েছে
এদিকে সোমবার বিকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে রিয়ার এডমিরাল আইলিন লাউবাচারের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিতর্কিত ধারার বিষয়ে মার্কিন উদ্বেগ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে সৃষ্ট নিরাপত্তা শঙ্কা এবং পুঞ্জীভূত ওই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে কথা হয়। সেই বৈঠকের বিষয়ে সরকারের তরফে রাতে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চার দিনের সফরে ঢাকায় আসা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল-এর সিনিয়র ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া রিয়ার এডমিরাল আইলিন লাউবাচার পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সিনিয়র ডিরেক্টর গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা দশ লক্ষেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি এবং আশ্রয় প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় সিদ্ধান্তের আন্তরিক প্রশংসা করেন। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য প্রচুর সম্পদের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তার বিষয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র সচিব জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিভিন্ন রেজুল্যুশনে সমর্থন এবং রোহিঙ্গা গণহত্যাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মার্কিন সরকারের প্রশংসা করেন।
এ ছাড়াও তারা পারস্পরিক স্বার্থ ও অগ্রাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয় বিশেষ করে মানবিক সহায়তা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সমুদ্র বিষয়ক নিরাপত্তা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ শক্তিশালীকরণ, সাইবার নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স কর্নেল ব্রিয়াল লুটি, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাউথ সেন্ট্রাল এশিয়া ব্যুরোর অফিস ফর নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ-এর ডিরেক্টর স্কট উরবম, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশন মিজ হেলেন লাফেইভ এবং পলিটিক্যাল সেকশনের চিফ আরথরো হাইনেস। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) মো. খুরশেদ আলম, আমেরিকাস অনুবিভাগের বিদায়ী মহাপরিচালক নাঈম উদ্দীন আহমেদ, উত্তর আমেরিকা নামে পুনর্গঠিত (আমেরিকাস) অনুবিভাগের নতুন মহাপরিচালক মাসুদুল আলম, মহাপরিচালক (মিয়ানমার) মিয়া মো. মাইনুল কবির এবং উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের পরিচালক হাসান আব্দুল্লাহ তৌহিদ। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ৮ই জানুয়ারি মার্কিন প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগসহ অন্যান্য সুবিধাদি পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া সোমবার অপরাহ্ণে মার্কিন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে ক্লোজডোর একটি গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে মানববন্ধন
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাঈদ ফয়সাল ‘হত্যার’ বিচারের দাবিতে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে মানববন্ধন হয়েছে। কেমব্রিজের একজন পুলিশ অফিসারের গুলিতে গত বুধবার ‘সশস্ত্র’ ফয়সাল নিহত হন। মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে এই প্রতিবাদ জানানো হয়। নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সংকট ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ৪ দিনের সফরে ঢাকা এসেছেন লাউবাচার। মানববন্ধনে সাংবাদিক ও কলামিস্ট অজয় দাস গুপ্ত বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে মার্কিন পুলিশ এমন একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে, যিনি কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি। আমরা এর বিচার চাই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জাতিগত সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও তারা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে মানবাধিকার বিষয়ে অন্যান্য দেশকে পরামর্শ দিচ্ছে। আমরা চাই না আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক। তবে যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরাই ব্যবস্থা নেবো, অন্যের পরামর্শে নয়। মানববন্ধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি হাসিবুর রহমান মানিক জানান, তারা ফয়সাল হত্যার বিচার চান এবং এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে একটি ভালো বিচার প্রক্রিয়া রয়েছে এবং সেখানকার কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
নিহত বাংলাদেশির ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্তের বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের
ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী সাঈদ ফয়সালের নিহতের ঘটনায় পরিবার এবং প্রিয়জনদের প্রতি সমবেদনা ও পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছ তদন্তের কথা জানিয়েছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস। সোমবার ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রাইডেনো এক বিবৃতিতে স্বচ্ছ তদন্তের কথা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, সাঈদ ফয়সালের পরিবার ও প্রিয়জনদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের আহ্বানকে সমর্থন করে মার্কিন জেলা অ্যাটর্নি অফিসের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য অনুরোধ জানানো হবে।