ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতের শিল্পগ্রুপ আদানির কাছ থেকে অন্তত ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ না নিলে উচ্চ অংকের জরিমানা গুনতে হবে পিডিবিকে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রিতে অন্যায্য সুবিধা পাচ্ছে আদানি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে আদানির চুক্তিপত্র ঘেঁটে এ রকম তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে চুক্তিপত্রের ফটোকপি পেয়েছে সমকাল। ১৬৭ পৃষ্ঠার চুক্তিপত্রে দেখা যায়, আদানিকে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিককে সেই সুবিধা দেওয়া হয়নি। ভারতের ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসার কথা।
বিশ্বাসযোগ্য সূত্রমতে, আদানিকে নজিরবিহীনভাবে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পায়রাতে বাংলাদেশ ও চীনের মালিকানাধীন দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী, বরগুনা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রামের এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব সুবিধা আদানি পেয়েছে, এর একটিও এই ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়নি। আদানিকে দেওয়া অতিরিক্ত সুবিধার মধ্যে রয়েছে ঘোষিত চাহিদার থেকে কম বিদ্যুৎ নিলে ব্যবহার না করা কয়লার দাম বাংলাদেশকে দিতে হবে। যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ, কেন্দ্র পরিচালনা, কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট– সব মিলিয়ে চুক্তিতে থাকা শর্তগুলো অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া হয়নি। এর ফলে এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পেতে বাংলাদেশকে বেশি ব্যয় করতে হবে। গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ আদানি চাইলে পিডিবি ছাড়াও যে কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে। অথচ কেন্দ্রটির নির্মাণের অর্থ, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন থেকে সবকিছুর বিনিয়োগ ধরেই কেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে। এ চুক্তিটি সই হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর।
কয়লার পরিমাণ বেশি নিয়েছে আদানি: গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম লোডে চললে বা কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তুলনামূলক বেশি গ্যাস বা জ্বালানির দরকার পড়ে। এ কারণে গ্যাসের টারবাইনভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম লোডে চললে তারা জ্বালানি কিছুটা বেশি পায়, তখন যন্ত্রের দক্ষতা কমে যায়। এটাকে হিট রেটও বলা হয়। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো স্টিম টারবাইনভিত্তিক। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র কম লোডে চললেও জ্বালানি ব্যবহারের তেমন হেরফের হয় না। কিন্তু আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তিতে কম লোডে বিদ্যুৎকেন্দ্র চললেও কয়লার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে আদানি হিট রেট পাবে ২৪৩২; এভাবে যত নিচের দিকে যাবে, লোড বা কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, তত বেশি হিট রেট পেয়েছে আদানি। গড়ে সারাবছর যদি ৫০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বা স্থাপিত ক্ষমতার অর্ধেক চালায় আদানি, তাহলে তারা হিট রেটে পাবে ২৫৫৫। অথচ পায়রাতে হিট রেট ফ্লাট বা সমান ২৩০০। কম বা বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পায়রাতে কয়লা ব্যবহার কম বা বেশি হওয়ার বিধান নেই। পায়রাতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনা কোম্পানি নরেনকোর অর্ধেক মালিকানা রয়েছে, সেখানে বাকি অর্ধেক মালিকানা রয়েছে সরকারের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের। এই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিতে হিট রেট আরও কম, সেটি ২২৭০। এই হিট রেট ফ্লাট।
বিদ্যুৎ খাতের একাধিক প্রকৌশলী চুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, সারাবছর ৫০ শতাংশ ক্ষমতায় যদি পায়রাতে নরেনকো কেন্দ্র সচল রাখে এবং একই সময় ৫০ শতাংশ ক্ষমতায় আদানি ঝাড়খন্ডের গোড্ডা কেন্দ্র সচল রাখা হয়, তাহলে এক বছরে আদানি ৪ লাখ ৫ হাজার টন কয়লার দাম বেশি পাবে। আদানির দেওয়া বর্তমানে কয়লার মূল্য হিসেবে এই পরিমাণ কয়লার দাম সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। তাদের ব্যাখ্যামতে, পায়রাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান আরপিসিএল ও নরেনকোর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৯৩.৪৮ গ্রাম কয়লার দাম পাবে। আর সেখানে আদানি প্রতি ইউনিটের জন্য পাবে ৫৫৫.৪৩ গ্রাম কয়লা। চুক্তিতে হিট রেটে ফ্লাট না থাকায় এবং বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে আদানি এই সুযোগ পেয়েছে।
বিদ্যুৎ না নিলেও কয়লার দাম পুরো দিতে হবে: চুক্তিতে বলা হয়েছে, আদানির কাছ থেকে প্রতি চার মাস পর পর কত বিদ্যুৎ পিডিবি নেবে, সেটি আগেভাগে জানিয়ে দিতে হবে। ধরা যাক, আদানির কাছ থেকে পুরো ক্ষমতার ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ নেবে বলে চাহিদাপত্র (ডিমান্ড নোট) দিয়েছিল পিডিবি। বাস্তবে চার মাসে পিডিবি বিদ্যুৎ নিয়েছে ৫০ ভাগ। তাহলে বাকি ৩০ ভাগের কয়লার দাম আদানিকে দিতে হবে। ডিমান্ড নোট বা চাহিদার যত কম বিদ্যুৎ পিডিবি নেবে, ততটুকু বিদ্যুতের কয়লার দাম, জাহাজ ভাড়া, বন্দরের খরচ দিতে হবে পিডিবিকে। পিডিবির সঙ্গে চুক্তিতে বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার এ রকম বাধ্যবাধকতা নেই। আদানির কাছে যদি চার মাসের চাহিদাপত্র নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, সেভাবে কোনোদিন পিডিবি বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। কারণ, আদানির বিদ্যুৎ আসবে উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়াতে। ওই এলাকায় এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ নেওয়ারই সক্ষমতা নেই। সে কারণে আদানিকে বিদ্যুৎ না নিয়েও কয়লার অর্থ দিতে হবে। এ রকম চুক্তি অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে নেই। চুক্তি অনুযায়ী আদানিকে ২৫ দিনের কয়লা মজুত রাখতে বলেছে পিডিবি। কিন্তু পিডিবি যদি চাহিদাপত্রের কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলে আদানিকে কয়লার দাম দিতে হবে চার মাসের, মানে ওই প্রান্তিকে চাহিদাপত্র অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটুকু কয়লা লাগত, তার পুরোটার দামই দিতে হবে পিডিবিকে।
৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিলে জরিমানা: ঝাড়খন্ডের গোড্ডার আদানির দুটি ইউনিটের মোট ক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তবে এটির স্থাপিত ক্ষমতা বা প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট। এই ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াটের মধ্যে সারাবছর ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে নিতেই হবে। বাংলাদেশ যদি এর কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার পুরোটার দাম পিডিবিকে গুনতে হবে। শুধু কয়লার দামই নয়, কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া, বন্দরের ব্যয় ও কয়লা পরিবহনের অর্থ পাবে আদানি। বাংলাদেশে পাঁচটি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এই পাঁচটিতে এ রকম কোনো শর্ত নেই। যতটুকু বিদ্যুৎ পিডিবি নেবে, ঠিক ততটুকু বিদ্যুতের জন্য ব্যবহৃত কয়লার দাম দেবে পিডিবি। এই পাঁচটির মধ্যে দুটি কেন্দ্র বর্তমানে উৎপাদনে এসেছে, সেই কেন্দ্র দুটি যথাক্রমে পায়রা ও রামপালের কয়লার দাম এভাবেই দিচ্ছে পিডিবি।
বাণিজ্যিক উৎপাদনের আগেই অর্থ দাবি করতে পারবে: চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলক চালু হওয়ার ৬০ দিনের মাথায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে (সিওডি বা কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট) যাবে কেন্দ্র। কিন্তু পিডিবির কারণে যদি কেন্দ্রটি ৬০ দিনের মধ্যে সিওডি না হয়, তাহলে কেন্দ্রের ঋণের কিস্তি (মূলত ক্যাপাসিটি চার্জের মধ্যে ধরা থাকে, যা নন–স্কেবল বা স্থির কেন্দ্রভাড়া বলা হয়) পরিশোধ করবে পিডিবি। যদি সিওডি করতে পিডিবি এর থেকে বেশি সময় নেয়, তাহলে পুরো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া পাবে আদানি। ঋণের কিস্তির এই অর্থ আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পরিশোধ করতে পারবে, কিন্তু সেসব অনেক সমীকরণের ওপর নির্ভর করে। যে ব্যাংক থেকে কিস্তি নেওয়া হয়েছে, সেখানকার তহবিল, সুদের হার নানা ধরনের বিষয়ের ওপর কিস্তির অর্থ পিডিবির সঙ্গে সমন্বয় করা নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে সিওডি হওয়ার আগে আদানিকে দেওয়া কিস্তির অর্থ পিডিবি ফেরত নাও পেতে পারে। কী শর্তে ঠিক কত টাকা ঋণ নিয়েছে আদানি, সেটা পিডিবিকে জানায়নি। ফলে এই কিস্তির পরিমাণ নিয়েও বেশ সুবিধায় থাকবে আদানি।
ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেশি নিয়েছে: আদানি ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেশি নিয়েছে। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের মধ্যে চারটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো পরিবর্তনশীল কেন্দ্র ভাড়া, স্থির কেন্দ্র ভাড়া, ইউএস সিপি ইনডেক্স (যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার) ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ। বছরে আদানি শুধু কেন্দ্র ভাড়াই নেবে ৬ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিপিএ ও সমমানের অন্য দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পিপিএ বিশ্লেষণ করে খাত-সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, আদানির চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করা হয়েছে ট্যারিফ ফর্মুলায়। এর ফলে পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পিপিএ অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিবর্তনশীল অংশটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে। প্রথম বছর প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে ২১.৮৯২৭ মার্কিন ডলার। ২৫তম বছরে তা কমে হবে ১৪.৬২৭০ মার্কিন ডলার। ক্যাপসিটি চার্জের অপরিবর্তনশীল অংশটি আদানির পিপিএতে প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ৩.৬৫ ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে কস্টপ্লাস ফর্মুলায়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি আসবে। পাওয়ার সেলের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি পড়ছে। পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের ১২৪৪ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৩ পয়সা। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের ১২২৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ টাকা ৭১ পয়সা। বরগুনার বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার ৩০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ধরা হয়েছে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা। আদানির ঝাড়খণ্ডের ১৬০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকা ৫৫ পয়সা। গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আদানি ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ না কিনলেও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। ২৫ বছরে এ চার্জ পরিশোধে বাংলাদেশের ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।
সিস্টেম লসে লাভ: চুক্তিতে আদানিকে কয়লার সিস্টেম লস ধরা হয়েছে ১.১০ শতাংশ। অর্থাৎ এক লাখ টন কয়লায় আদানি ১ হাজার ১০০ টন কয়লা নষ্ট দাবি করে তার দাম নিতে পারবে। পায়রায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও রামপাল কেন্দ্রে সিস্টেম লসের বিধান রাখা হয়নি।
কয়লার দামে কারসাজির সুযোগ: আদানির সঙ্গে চুক্তিতে ইন্দোনেশিয়ার ইনডেক্স ও নিউ ক্যাসেল ইনডেক্সের গড় ধরার কথা বলা হয়েছে। এখন আদানি তার কেন্দ্রে ব্যবহার করবে ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা। আর নিউ ক্যাসেল ইনডেক্সে কয়লার ক্যালরিফিক মান ধরা হয়েছে ৬৩২২। ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লার দাম কম ও ৬৩২২ ক্যালরিফিক মানের কয়লার দাম অনেক বেশি। এই দুই দামের গড় করে প্রতি টন কয়লার দাম ঠিক করা হবে। অথচ আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা ব্যবহার হবে ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা। কয়লার দামে কোনো ডিসকাউন্ট রাখা হয়নি। অথচ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের কয়লা কিনছে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট রেটে।
পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, কয়লার ক্যালরিফিক মান আদানি ঠিকমতো ঘোষণা করবে– এর নিশ্চয়তা নেই। কারণ অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ার যেখান থেকে কয়লা আসবে সেই খনি আদানির, যে জাহাজে আসবে সেটি আদানির, ভারতের উড়িষ্যার ধামরা বন্দরে খালাস হবে সেই বন্দরও আদানির। কয়লার ক্যালরিফিক মান যে ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে সেটিও আদানির। কয়লা পরিবহনের কোনো পর্যায় পিডিবির কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ রাখা হয়নি। তাঁরা আরও বলছেন, যদি ৫০০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা আমদানি করে ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা আনার ঘোষণা দেয় আদানি, তাহলে আদানিকে বেশি পরিমাণ কয়লার দাম দিতে বাধ্য হবে পিডিবি। কারণ কয়লার ক্যালরিফিক মানের ওপর নির্ভর করে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার পরিমাণ। যত বেশি উন্নত ক্যালরিফিক মানের কয়লা, তত কম লাগে কয়লার পরিমাণ। কারণ এর হিটিং ভ্যালু বেশি। সমালোচনা ওঠার পর সম্প্রতি ঢাকায় কয়লার দর নিয়ে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা পায়রার মতো ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টরে দর নির্ধারণে রাজি হয়। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ছাড় দিলেও আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হবে।
কর ছাড়ের সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ: সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদন অনুসারে আইনে পরিবর্তন এনে ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ২০১৯ সালে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণা করে ভারত সরকার। এর ফলে নানা ধরনের কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। ২৫ বছরে কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে প্রদেয় এক ধরনের কর মওকুফ বাবদ আদানির ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে। এ ছাড়া কয়লা ও যন্ত্রাংশ আনতে কোনো আমদানি শুল্ক দিতে হবে না। প্রথম পাঁচ বছরের জন্য আয়ে কোনো কর নেই। ১০০ শতাংশ ছাড়। পরের পাঁচ বছরের আয়ে ৫০ শতাংশ ছাড়। সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, এমন সুবিধা প্রাপ্তির পরপরই পিডিবিকে জানানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি। যদিও চুক্তির ১৩ ডি (আই) ধারা অনুযায়ী, কর শুল্ক পরিবর্তন হলে তা পিডিবিকে অবশ্যই ৩০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে হবে। পিপিএ বিশ্নেষণকারী একাধিক ব্যক্তি বলেন, চুক্তি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে বাংলাদেশ কর ছাড়ের সুযোগ ভোগ করতে না পারে। ফলে আদানি কর সুবিধায় লাভ করলেও বাংলাদেশকে ঠিকই এসব খরচ বহন করতে হবে।
দায় শুধু পিডিবির: আদানির চুক্তি বিশ্লেষণ করে দু’জন বিশেষজ্ঞ বলেন, এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই পিডিবির। আদানি পাওয়ার চুক্তির কোনো ধারা না মানলেও চুক্তি থেকে পিডিবি বেরিয়ে আসতে পারবে না। সমাধান খোঁজার জন্য আদানিকে সময় দিতে হবে। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও আদানিকেই বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। চুক্তিতে কেন্দ্রটির স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল সব খরচের সব ধরনের বিনিয়োগ ঝুঁকি পিডিবির ওপর চাপানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পায়রা ও রামপাল চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ বা আইন পরিবর্তনের মতো রাজনৈতিক ঘটনাকে বলপূর্বক পদক্ষেপ (ফোর্স মেজার্স) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে কোনো কিছু ঘটলে তার দায় থেকে উভয় পক্ষই মুক্তি পাবে। কিন্তু আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, এমন কোনো ঘটনায় বিদ্যুৎ না কিনতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ, জরিমানাসহ সব দায় পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। কিন্তু একই কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। চুক্তি অনুসারে রাজনৈতিক কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা মেরামত ও এই সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় বহন করবে পিডিবি। রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এমন ধারা নেই। গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্যও বিশেষ সুবিধা পাবে আদানি।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে এমনিতেই হরিলুট চলছে। বিশেষ আইনের সুযোগে দরপত্র ছাড়াই শতাধিক বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তির জালিয়াতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হবে উল্লেখ করে তিনি তা বাতিলের দাবি জানান। চুক্তি নিয়ে কথা বলতে আদানির ঢাকা অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, আদানির বিদ্যুৎ অন্য কেন্দ্রগুলোর মতোই হবে। তাঁর মতে, এতে বাংলাদেশের লোকসান হবে না। বরং উত্তরাঞ্চলের লোডশেডিং থেকে পরিত্রাণ মিলবে।