ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম, অপহরণের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব গুম, অপহরণের শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী। এসব অপরাধ প্রতিরোধে, তদন্তে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে সীমিত প্রচেষ্টা নিয়েছে ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকার।
ওদিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ঘন ঘন এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বাংলাদেশ অধ্যায়ে বিস্তারিত রিপোর্ট তুলে ধরে। ২০২২ সালের ঘটনার ওপর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে গুম নিয়ে বলা হয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ এবং মিডিয়ার রিপোর্টে অব্যাহত গুম এবং অপহরণের তথ্য উঠে এসেছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এসব সংগঠিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় একটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন রিপোর্ট করেছে যে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন ১৬ জন। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো বলেছে, জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, অধিকারকর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী। গুমের অভিযোগ উঠার পর কোনো অভিযোগ ছাড়াই কিছু ব্যক্তিকে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন ব্যক্তিদের ছেড়ে দিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী।
মে মাসে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস, দ্য এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস, স্থানীয় সংগঠন মায়ের ডাক এবং অধিকার একটি পাবলিক চিঠি ইস্যু করে। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলেও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের জোরপূর্বক গুম করা হচ্ছে সরকারের মদতে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের এ নিয়ে মুখ না খুলতে ঘন ঘন ভয়ভীতি এবং হুমকি দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীরা বলেন, জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার থেকে অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ তা নিবন্ধিত করে না। এপ্রিলে মায়ের ডাক সংবাদ সম্মেলন করে। এতে তারা জানায়, জোরপূর্বক গুম অব্যাহত আছে। বিশেষ করে এর শিকার হচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। আগস্টে এই সংগঠনটি দাবি করে, ভিকটিমের পরিবারের নারী সদস্যদের চরিত্র হননের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বানোয়াট ছবি আপলোড করছিল ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা। ওদিকে ভয়াবহ জোরপূর্বক গ্রুমের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে যে সমালোচনা করা হয় তা প্রত্যাখ্যান করে সরকার। জানুয়ারিতে তাদের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এরই মধ্যে ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করে ফ্রিডম হাউস। তাতে বলা হয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরপূর্বক গুম, তাদের হেফাজতে মৃত্যু, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও নির্যাতনসহ বহুবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত ছিল। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের ৭১টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে মার্চে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, গুমের শতকরা ৪০ ভাগের জন্য দায়ী র্যাব। অন্যদিকে শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, গুমের এক তৃতীয়াংশ ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। এর শিকার বেশির ভাগই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী। ভিকটিমদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগ হলেন শিক্ষার্থী।
ফটো সাংবাদিক ও নিউজ এডিটর শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম জুনে স্থগিত করে হাইকোর্ট। সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে জোর করে ২০২০ সালে আটক করে সরকার এবং গোপনে আটকে রাখে ৫৩ দিন। মানহানির অভিযোগে তিনি মোট ২৩৭ দিন জেলে কাটান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্তি পান।
মে মাসে পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের মোট ৮১টি ঘটনা তদন্ত করছে। বছরের শুরুতে তারা জোরপূর্বক গুমের কিছু ঘটনায় সরকারের কাছে তথ্য চায়। কিন্তু ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস বলেছে, গুমের শিকার মানুষগুলোর পরিণতি কি হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য ওই তথ্যগুলো পর্যাপ্ত ছিল না। সংস্থাটি রিপোর্ট করেছে যে, তারা নিয়মিতভাবে গুমের অভিযোগ পাচ্ছিল। এর শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানে সংবাদ মাধ্যম এবং মিডিয়ার সদস্যসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার। অনলাইন এবং অফলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত ছিল। হয়রানি অথবা প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে মিডিয়ার সদস্যরা এবং ব্লগাররা নিজেরাই সেন্সরশিপ চালিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এমন অপরাধে অভিযুক্ত হলে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন শাস্তি হতে পারে। ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য সীমিত করা হয়েছে আইন দিয়ে। কিন্তু ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্যের বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এর ফলে সরকার ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সাইবার অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য পাস করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানোর অপরাধে যাবজ্জীবন জেলের বিধান আছে। করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নে করা সহ সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে এই আইন ব্যবহার করেছে সরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট অথবা অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফরমে পাওয়া বক্তব্য, বিশেষ করে দেশের বাইরে থেকে যারা বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইন। এপ্রিলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২২৪৪ জন মানুষ। এর বেশির ভাগই সাংবাদিক এবং রাজনীতিক। ওই রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি মাসে গড়ে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২ জনকে। ২০২১ সালে এই আইনে গ্রেপ্তারের হার বাড়তে থাকে। পরের বছর তা অব্যাহত থাকে। আলাদা রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই অভিযোগের মুখোমুখি শিশুরাও। দেশের ১২টি জেলায় ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২০টি শিশুর বিরুদ্ধে এমন কমপক্ষে ১৮টি মামলা আছে। মার্চে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট করে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, মানবাধিকারের পক্ষের কর্মীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠকে টার্গেট করে ও হয়রানি করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ নম্বর, ২৯ নম্বর এবং ৩১ নম্বর ধারা ব্যবহার করা হয় সিস্টেম্যাটিক্যালি। ইন্টারন্যাশনাল কোভ্যানেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ, এসব কর্মকাণ্ড তার বিপরীত। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনসহ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর শারীরিকভাবে হামলা চালায়। হয়রান করে। ভীতি প্রদর্শন করে। এর মধ্য দিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীনরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে এই আইন ব্যবহার করছে বলে মানবাধিকারকর্মীদের পর্যবেক্ষণ। সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল বলেছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠরুদ্ধ করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সংগঠনটির সদস্যরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছেন। গ্রেপ্তারের হুমকিতে ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। বিচারের আগেই অনেককে আটক রাখা হয়। তাদেরকে ব্যয়বহুল ক্রিমিনাল বিচারের মুখোমুখি করা হয়। জরিমানা করা হয় জেল দেয়া হয়। এডিটরস কাউন্সিলের মতে, এই আইনে অপরাধ এবং শাস্তি সম্পর্কিত ২০টি ধারা বা ক্লজ আছে। এর মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য। ৫টি জামিনযোগ্য। একটি সমঝোতাবিষয়ক।