ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আবারও বিরোধে জড়িয়েছেন মিডনাইট সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
রওশনের পক্ষ নিয়ে জাপা থেকে বহিষ্কার হওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গা, জিয়াউক হক মৃধাসহ কয়েক নেতাকে দলে ফেরাতে রাজি নন জি এম কাদের। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন অনিশ্চিত বলে রওশনপন্থি কয়েকজনও ঐক্যে নারাজ। এদিকে রওশন বলয়ের সবাইকে দলে ‘পুনর্বাসনে’ রাজি নন জি এম কাদেরপন্থিরা। এই তিন কারণেই দেবর-ভাবির বিরোধ মিটছে না।
টানা কয়েক মাসের বিরোধে জাপা ভাঙনের মুখে পড়ে গত বছর। চলতি বছরের শুরুতে ‘সরকারি মধ্যস্থতায়’ সমঝোতা হয়। গত ৯ জানুয়ারি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের যুক্ত বিবৃতিতে ঐক্যের ডাক দেন। বছরের প্রথম দিনে জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জি এম কাদেরের সঙ্গে এক মঞ্চে ছিলেন রওশন এরশাদ এবং তাঁর ছেলে রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ।
তাঁরা এক মঞ্চে আসায় ধারণা করা হচ্ছিল, বিরোধ মিটেছে। আদালতের রায়ে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাপার এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়ে যৌথ সভা করেন জি এম কাদের। তাতে যোগ দেন জাপার যুগ্ম মহাসচিব সাদ এরশাদও। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রওশনের পক্ষ নিয়ে জি এম কাদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং মামলা করে দলীয় চেয়ারম্যানকে নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে ফেলা সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা ক্ষমা পাবেন না। এতেই সূত্রপাত হয় বিরোধের। এই ধারাবাহিকতায় ২০ মার্চ পৃথকভাবে অনুসারীদের নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন পালন করেন রওশন এরশাদ। গত সোমবার নিজ অনুসারীদের নিয়ে ইফতার করেন। তাতে দাওয়াত পাননি জি এম কাদের, জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা।
জি এম কাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে লাগাতার সমালোচনা করলেও দুই অনুষ্ঠানেই রওশন বলেন, সাংবিধানিক ধারা মেনে হবে আগামী নির্বাচন। তাতে অংশ নেবে জাপা। এরশাদের দিয়ে যাওয়া নির্দেশনা যাঁরা মানবেন না, তাঁরা দলের ও নিজের ক্ষতি ডেকে আনবেন। এ ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হলে দলের সংস্কার করতে হবে কাউন্সিল করে।
রওশনপন্থিদের ভাষ্য, যেসব শর্তে ‘সরকারি মধ্যস্থতায় সমঝোতা’ হয়েছিল তা রক্ষা করেননি জি এম কাদের। রওশনের পক্ষে রয়েছেন জাপার আট সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, যাঁদের বাদ দিয়েছিলেন জি এম কাদের। তাঁদের দলে পুনর্বহাল করা হয়নি। দশম সংসদের চারজনসহ অন্তত ১০ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি রয়েছেন রওশনের পক্ষে। তাঁদেরও দলে নিচ্ছেন না জি এম কাদের।
জি এম কাদের বলেছেন, কাউকে ‘পুনর্বাসন’ করা হবে না। তিনি সমকালকে বলেন, দল থেকে বাদ পড়া এবং বহিষ্কৃত কিছু নেতা রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে, তাঁকে সামনে রেখে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। তাঁরা যা ইচ্ছা করতে পারেন। তাঁদের নিয়ে জাতীয় পার্টির আগ্রহ নেই।
রওশনের অনুষ্ঠানে জাপার তিনি এমপি– গোলাম কিবরিয়া টিপু, নাজমা আকতার এবং রওশন আরা মান্নান গিয়েছিলেন।
জি এম কাদের বলেছেন, ‘টিপু মনে করেছিলেন ম্যাডাম (রওশন) ডেকেছেন। তাই না বুঝে গিয়েছিলেন।’
জাপা সূত্রের খবর, বিরোধের অন্যতম কারণ আগামী সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন। জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে জাপা। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে জাপার নেতৃত্বে জোট হবে। সেই জোট বিএনপির বিকল্প হবে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত নয় বলেই রওশনপন্থিরা ঐক্যে রাজি নন।
রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জি এম কাদের। ওই আসনের এমপি সাদ এরশাদ আগামী নির্বাচনেও মনোনয়নের নিশ্চয়তা চান। মসিউর রহমান রাঙ্গা রংপুর-১ আসনের এমপি। ২০০৮ সালে ওই আসনের এমপি ছিলেন এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার মকবুল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রওশনের ‘আশীর্বাদে’ এমপি হন রাঙ্গা। জি এম কাদের নেতৃত্বে আসার পর দলীয় রাজনীতিতে ফিরেছেন আসিফ। তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকে এমপি হয়েছেন। এই আসনে প্রার্থী হতে চান সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। জাপার সাবেক এই প্রেসিডিয়াম সদস্যকে ‘কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির’ সদস্য সচিব করেছেন রওশন।
লিয়াকত হোসেন বলেছেন, গোলাম মসীহ অনেক আগে দল ছেড়েছেন। বিদেশে থাকা গোলাম মসীহর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে তিনি একাধিকবার সমকালকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জাপায় আছেন। দল করতে কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই। রওশন এরশাদকে ছাড়া কেউ এমপি হতে পারবে না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে গত মাসের উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি জাপা। রওশনের সমর্থন নিয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তবে নির্বাচন থেকে সরে যান বিএনপি থেকে দলছুট হয়ে ভোটে দাঁড়ানো উকিল আবদুস সাত্তার ভূঞার সমর্থনে। ওই আসনে একাদশ নির্বাচনে জাপার প্রার্থী হয়েছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই নেতা জিয়াউল হকের জামাতা। শ্বশুরের আসনে তিনি আবারও প্রার্থী হতে চান আওয়ামী লীগের সমর্থন পেলে। জিয়াউল হক বলেছেন, রওশন তাঁর নেত্রী। রওশনেরই প্রার্থী হবেন।
রওশনের সঙ্গে সমঝোতা হলে জি এম কাদেরের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন রাঙ্গা। তবে এতে বরফ গলেনি। রাঙ্গা এবং মৃধাকে দলে ফেরানোর বিষয়ে জি এম কাদের সমকালকে বলেছেন, ‘আপাতত তাঁদের বিষয়ে ভাবার কোনো সুযোগই নেই।’ দলের জন্য কার কী অবদান, কে কতটা সুশৃঙ্খল, তা বিবেচনা করেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান।
নতুন করে সৃষ্ট বিরোধের বিষয়ে রওশন এরশাদের বক্তব্য জানা যায়নি। বিদেশে চিকিৎসা শেষে ফিরলেও রওশন এখনও অসুস্থ বলে জানিয়েছেন তাঁর অনুসারীরা। তিনি এরশাদের জন্মদিনে এবং ইফতার মাহফিলে এলেও লিখিত বক্তব্যের বাইরে কিছু বলেননি। কথা বলেননি সাদ এরশাদ।
জানুয়ারিতে ‘ঐক্যের’ পর রওশনপন্থিদের কার্যক্রম থেমে গিয়েছিল। বিভিন্ন জেলায় পাল্টা কমিটি গঠন, সংবাদমাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া বন্ধ হয়েছিল। চলতি মাস থেকে তা আবার শুরু হয়েছে। রাজশাহীতে মেয়র পদে রওশনের পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
এরশাদের জীবদ্দশা থেকেই রওশন এবং জি এম কাদেরের বিরোধ চলছে নেতৃত্ব নিয়ে। জি এম কাদের বিএনপির সুরে কথা বলছেন– এ অভিযোগ তুলে তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে গত আগস্টে রওশন কাউন্সিল ডাকলে বিরোধ চরমে পৌঁছে। পাল্টা হিসেবে রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে চেষ্টা করেন জি এম কাদের। কিন্তু সরকারের সমর্থন রওশনের পক্ষে থাকায় পারেননি। বরং মৃধার মামলায় পড়ে সাড়ে তিন মাস দলীয় দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, জি এম কাদেরকে চাপে রাখলেও রওশনকে একতরফা সমর্থন দেয়নি সরকার। এখনও দিচ্ছে না। সর্বাত্মক সমর্থন না থাকায় কাউন্সিল করতে পারেননি রওশনপন্থিরা। কাউন্সিল হলে জাপার ভাঙন নিশ্চিত ছিল। এতে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা বিএনপির দিকে চলে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। এ কারণে দুই পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণে রেখে সমঝোতা করিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধ বাড়লেও এখনও দুই পক্ষ সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।