ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অবশেষে পুরোদমে ও স্থায়ীভাবে খুলে গেল ভারতমুখী ট্রানজিট সুবিধা। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রী পরিবহণ ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অনুমোদন করা হলো।
এ বিষয়ে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে গত ২৪ এপ্রিল একটি আদেশ জারি করেছে। এতে ট্রানজিট ব্যবস্থা কীভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা হবে তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের কাছে ভারতের অনেক ধরনের আবদার-অভিলাষের তালিকায় সবচেয়ে বড় ও বহুল আলোচিত প্রাপ্তিটি তারা পেয়ে গেলো। গত প্রায় তিন বছর যাবৎ পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল রান) ট্রানজিট ব্যবস্থার আওতায় চট্টগ্রাম ও মোংলা উভয় বন্দর দিয়ে ভারতের পণ্যসামগ্রী পারিবহণ করা হচ্ছিল। নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয় এই ট্রায়াল রান।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ‘কানেকটিভিটি’ কিংবা ’ট্রান্সশিপমেন্টে’র নামেই ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বা অর্জন কী? ট্রানজিট চুক্তিতেই সেটা স্পষ্ট। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তিটির শিরোনামেই উল্লেখ রয়েছেÑ ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ চুক্তি অনুসারে (‘টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’) ভারতের পণ্যসামগ্রী যাচ্ছে ভারতেই। আর, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত পাচ্ছে করিডোর সুবিধা। যা একতরফা, একমুখী তথা ভারতমুখী ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা।
কেননা এই ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশের কোন পণ্যসামগ্রী ভারতে রফতানি হচ্ছে না। এ ধরনের কথা চুক্তির শর্তেও নেই। বরং আগে যেখানে ভারতের মূল অংশ থেকে দেশটির ভূমি বেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে (দি সেভেন সিস্টার্স) অনেক দীর্ঘ ঘুরপথ পেরিয়ে মালামাল পরিবহণ করতে হতো, ট্রানজিট-করিডোর সুবিধায় এখন স্বল্প দূরত্বে এসে গেছে। অনায়াসে পণ্যসামগ্রী স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে। ব্যাপক সাশ্রয় হচ্ছে তাদের খরচ, সময় এবং অর্থের। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ৮টি সড়ক, মহাসড়ক রুট বা পথে (করিডোর সুবিধায়) ট্রানজিট পণ্য আনা-নেয়া করা হবে। ট্রানজিট-করিডোর সুবিধার মতো বিরাট প্রাপ্তিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে ভারত তার সড়ক, রেলওয়ে ও নৌপথের অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। বাংলাদেশের সাথে কানেকটিভিটি বা সংযোগের উপযোগী এবং পরিপূরক করে পরিকল্পিতভাবে তা ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক ট্রায়াল রানে ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর কয়েক দফায় সফলভাবেই চালান আনা-নেওয়ার পর অবশেষে ট্রানজিট ব্যবস্থা পুরোদমে চালুর লক্ষ্যে স্থায়ী আদেশ জারি করেছে এনবিআর। এর ফলে উভয় বন্দর দিয়ে ভারতের মূল ভূখ- থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নিয়মিত মালামাল পরিবহণ সহজ-সুগম করার পথ খুলে গেল। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই থেকে এ যাবৎ পরীক্ষামূলকভাবে ট্রায়াল রানে ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর কয়েকটি চালান বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আনা-নেওয়া হয়েছিল বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে। এখন এনবিআর-এর স্থায়ী আদেশ জারির ফলে নিয়মিত ট্রানজিট কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
এই আদেশে ট্রানজিট অপারেটর নিয়োগ, বন্দরে জাহাজ ভিড়া, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ঘোষণা, শুল্কায়ন, পণ্যের কায়িক পরীক্ষা, ট্রানজিট সময়কাল ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। পরীক্ষামূলক চালানে মাশুলের (ফি) যেসব খাতে ছিল নতুন আদেশে তা বহাল রাখা হয়েছে। তবে সড়কপথে ট্রানজিটের চালান আনা-নেয়ার সময় ‘এসকর্ট ফি’ (পাহারার মাশুল) বৃদ্ধি করা হয়েছে। আদেশে ট্রানজিট অপারেটর হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা এবং সড়কপথে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে।
ভারতের মূল অংশ থেকে দেশটির ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যÑ আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচলে মালামাল পরিবহণে দীর্ঘ ঘুরপথের কারণে সময় ও খরচ হয় বহুগুণ। ভারত চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার সুবাদে স্বল্পতম সময়েই বাংলাদেশের সড়ক দিয়ে করিডোর ব্যবস্থায় অনায়াসে ওই অঞ্চলে তাদের পণ্য পরিবহন করবে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে ট্রায়াল রানে ভারতীয় পণ্য জাহাজে আনা-নেয়া, খালাস কাজ সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের এক নম্বর জেটিতে এই জাহাজগুলো ভিড়ানো হয়। এই জেটি এখন বেশির ভাগ সময়ে খালি থাকছে। নিয়মিতভাবে ট্রানজিট চালু এবং এতে পণ্যসামগ্রী পরিবহণ বাড়লেও বন্দরের ওপর তেমন বেশি চাপ পড়বে না। তাছাড়া বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনালের (পিসিটি) নির্মাণকাজ শেষের দিকে। ফলে ট্রানজিট পণ্যের জাহাজ হ্যান্ডলিং করার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা বন্দরের রয়েছে।
এনবিআরের স্থায়ী আদেশ অনুযায়ী ভারতীয় মালামালের চালান চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ৮টি রুট বা পথে (অর্থাৎ করিডোর সুবিধায়) বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলবন্দর হয়ে ভারতে আনা-নেয়া করা যাবে। এই ৮টি রুট হচ্ছেÑ চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-তামাবিল ডাউকি, মোংলা বন্দর-তামাবিল-ডাউকি, চট্টগ্রাম বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, মোংলা বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।
এনবিআরের স্থায়ী আদেশে ভারতের ট্রানজিট পণ্য পরিবহণ বাবদ মাশুল নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এতে প্রতি চালানের প্রক্রিয়াকরণ মাশুল বা প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, টনপ্রতি ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি একশ’ টাকা, কন্টেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি একশ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আদেশে প্রতিটি কন্টেইনার বা গাড়ির জন্য প্রতি কিলোমিটারে এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে প্রতি চালানে এসকর্ট ফি ছিল ৫০ টাকা। তবে ইলেকট্রিক লক ও সিল ফি নামে আরেকটি খাত রয়েছে। এটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মাশুল দিতে হবে। বিভিন্ন প্রকারের মাশুলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আরোপ করা হবে। কন্টেইনার ওঠানামা বাবদ নির্ধারিত মাশুল রয়েছে উভয় বন্দরে। তাছাড়া ভারতীয় পণ্য আনা-নেয়ার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত শিপিং এজেন্ট, ট্রানজিট অপারেটর ও কন্টেইনার পরিবহণ বাবদ দেশীয় পরিবহণ খাতে নিয়মমাফিক ভাড়া আদায় করা হবে। কন্টেইনারপ্রতি কত টন পণ্য রয়েছে, জাহাজভাড়া কত ইত্যাদির ওপর নির্ভর করছে ফি-মাশুল-চার্জ-ভাড়া কতটা কম বা বেশি হবে। তবে সবকিছু মিলিয়ে দুই সমুদ্র বন্দর দিয়ে ট্রানজিট এবং আটটি রুট দিয়ে করিডোর সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে কার্যত তেমন আহামরি আয় আসবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শিপিং বাণিজ্যে দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যের ৯৩ শতাংশ হ্যান্ডলিং করা হয় । এর মধ্যে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৯৮ শতাংশ। প্রতিনিয়ত চাপ ও চাহিদা বেড়েই চলেছে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে পণ্যপ্রবাহ সামাল দিতে গিয়েই চট্টগ্রাম বন্দরের হিমশিম দশা। দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতকে একতরফা ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা দিতে বন্দরজট সহ নানামুখী সমস্যা তৈরি হতে পারে।
তাছাড়া ভূ-প্রাকৃতিকভাবে ভাটির দেশ বাংলাদেশের ভূমি প্রধানত বালুমাটির। নরম মাটির ওপর তৈরি দেশের রাস্তাঘাট-সড়ক, মহাসড়ক। এ অবস্থায় ট্রানজিটের ভারী ট্রাক-লরি, কাভার্ড ভ্যানের বহরের বাড়তি চাপে সড়ক ভেঙেচুরে ও দেবে যাবে। সার্বিকভাবে দেশের সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি হবে। এ অবস্থায় ট্রানজিট ও করিডোরের বিনিময়ে লাভালাভ খতিয়ে দেখা অপরিহার্য।