ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এযাবৎকালে নিজের সবচেয়ে স্পষ্ট বার্তাটি পাঠিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার জন্য একটি দ্রুত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অপরিহার্য।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল সফরের পরপরই ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন- এর মধ্যে গত ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকের সময় এই বার্তা দেওয়া হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের শুরুতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো বক্তব্যে সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর জোর দেন। তিনি "বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানব ও শ্রম অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচারে মার্কিন প্রতিশ্রুতি" এর কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলামের সম্পাদনায় দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে দেশটি থেকে প্রকাশিত মাসিক প্রকাশনা ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস’-এর এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করে লেখা হয়েছে: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তার কথা তুলে ধরলেও সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন এই কেন্দ্রীয় বার্তা থেকে পিছপা হননি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটিনাপ্রবাহ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন বলেছেন যে এই অঞ্চল এবং এর বাইরের জন্যেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করতে বিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ব্লিঙ্কেন এবং মোমেনের মধ্যে বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আরও বেশি অবক্ষয়, বিশেষ করে মিডিয়ার উপর আক্রমণ হয়েছে।
২৩ শে মার্চ দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে ২৮ মার্চ ভোররাতে সাদা পোশাকের পুলিশ তুলে নিয়ে যায় এবং দেশের বিদ্যমান আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে ৩০ ঘণ্টা তাকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। মামলাটি ড্রাকোনিয়ান- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এর অধীনে দায়ের করা হয়েছিল যা গত নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রণয়ন করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারিতে দেশটির প্রধান বিরোধী দলের মালিকানাধীন একটি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করে সেক্রেটারি বিঙ্কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সহ বিভিন্নভাবে মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন- বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে চাই।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কার্যকর করা এবং মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য তার সমর্থনের কথা বলে এসেছে। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর, বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকরা দেশটিকে কার্যকরভাবেই একটি একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিরোধী নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোট কারচুপির অভিযোগ এবং আগের মাসগুলোতে ভোটার ও বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর প্রার্থীদেরকে পদ্ধতিগতভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগে পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো ভন্ডুল হয়েছিল। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর মতো দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো নিরাপত্তা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডাদের দ্বারা ভোটার এবং প্রার্থীদের ভয় দেখানোর ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা সরকারগুলো এসব অভিযোগের তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে যেগুলোতে সরকার কর্ণপাত করেনি।
যদিও বৈঠকে মোমেন একটি অবাধ সুষ্ঠু, এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, হাসিনা সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। ক্ষমতাসীন দল নির্দলীয় প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধীদের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যাকে বিরোধীরা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করার চাবিকাঠি হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের দাবি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরূপ আহ্বানের সাড়া দিয়েছে মৌখিক আক্রমণ এবং ভিত্তিহীন পাল্টা সব অভিযোগের মাধ্যমে।
ব্লিঙ্কেন-মোমেন সাক্ষাতের আগের দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে ভণ্ডামির অভিযোগ তোলেন। সজীব ওয়াজেদ তার ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, "মার্কিন আইনসভার সদস্যরা ভোট দিয়ে দুই সংখ্যালঘু আইনপ্রণেতাকে বহিষ্কার করেছে, যদিও একজন শ্বেতাঙ্গকে রেখে দিয়েছে। এই হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক দল ভণ্ডদের আখড়া ছাড়া আর কিছুই নয়।" এই বক্তব্যের পরই আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য।
১০ এপ্রিল সংসদে এক বক্তৃতায় তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, আমেরিকা চাইলে যে কোনো দেশে ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে। তারা এখানে এমন একটি সরকার আনতে চায় যার কোনো গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব থাকবে না। একই ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, প্রথম আলো আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র এবং জাতির শত্রু।
সাউথ এশিয়া বিষয়ক প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় মিডিয়ার সমালোচনা ও নিপীড়নের বিষয়টি স্টেট ডিপার্টমেন্টের নজরে আনা হলে, এর প্রধান উপ-মুখপাত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে 'সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইন' হিসেবে অভিহিত করে বলেন, সর্বশেষ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৬২তম হয়েছে। আর সেজন্য সবচেয়ে বড় কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের বার্তা যতই জোর এবং দ্ব্যর্থহীন হয়ে উঠছে, (তার বিপরীতে) আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশেষ করে শেখ হাসিনা কী প্রতিক্রিয়া জানাবেন তা দেখার বিষয়। যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একটি বিষয়ে ক্রমবর্ধমান ঐকমত্য এই যে- আরেকটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন কেবল বাংলাদেশেই নয়, এই অঞ্চল এবং এর বাইরেও গুরুতর প্রভাব ফেলবে। গণতন্ত্রের সমর্থকদের আশা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভাব্য গতিপথের প্রতি লক্ষ্য রাখবে এবং জনগণের ম্যান্ডেট প্রতিফলিত হয় এমন অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য অটল অবস্থান গ্রহণ করবে।