ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে শুধু সরকারি কেনাকাটার জন্য সরকারি ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই(২০২২) থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে রিজার্ভ থেকে। বুধবার রিজার্ভ থেকে ৬০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলোর চাহিদা ছিল অনেক বেশি। যেমন, একটি সরকারি ব্যাংকের গত মঙ্গলবারে পণ্য আমদানির দায় বকেয়া ছিল প্রায় ৬২ কোটি ডলার, বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক ওইদিন ব্যাংকটির কাছে বিক্রি করেছে মাত্র ১ কোটি ডলার। যদিও কোনো কোনো এলসির দায় ৬০ বার পর্যন্ত সময় পেছানো হয়েছে। অর্থাৎ বিদেশী ব্যাংকের কাছে ৬০ বার কমিটমেন্ট ফেইল করেছে ব্যাংকটি। এসব দায় অচিরেই পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় দেশের ওই ব্যাংকটির সুনাম বিদেশে আরো ক্ষুন্ন হবে, বাড়বে ব্যয়ও। সবমিলেই আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যাবে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাতে তেমন কোনো সুখকর কিছু নেই। এতে ঘাটতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে আমদানি ব্যয়ে অস্বাভাবিব প্রভাব পড়েছে। মার্চে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ২৮ শতাংশের ওপরে। যেখানে আগের বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। আমদানি প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে কমলেও রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তা দিয়ে সমন্বয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর বাইরে তো প্রতি মাসেই বিদেশে চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমন বয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঋণও সুদে আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার আয় দিয়ে আমদানি ব্যয়ই মেটাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করতে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত এপ্রিলে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হয়েছে ১৬৮ কোটি মার্কিন ডলার। আর রফতানি আয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হয়েছে ৩৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। প্রধান এ দুই খাত মিলে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হয়েছে ৫৬৩ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু গত মার্চে শুধু পণ্য আমদানিবাবদই ব্যয় হয়েছে ৫৫৬ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। বরং গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি এপ্রিলে ২৪ শতাংশ কমে গেছে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি, ওমানে কর্মী নিয়োগ কমে যাওয়ায় সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। গত এপ্রিলে প্রায় ৭৮ হাজার ৮৩৩ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ কম। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপর।
গত এপ্রিলে ঈদের মাস হওয়া সত্ত্বেও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। সামনের মাসগুলোতেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, রফতানি আয়ও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের এপ্রিলে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে ৫১.৫৮ শতাংশ, সেখানে চলতি বছরের এপ্রিলে রফতানি না বেড়ে বরং কমেছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের এপ্রিলে রফতানি আয় হয়েছিল ৪৭৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, সেখানে চলতি বছরের এপ্রিলে এসেছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। করোনা পরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধে আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভূক্ত দেশসমূহে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। আবার শিল্পের কাঁচামালের দামও বেড়ে গেছে। পাশাপাশি আমাদের শিল্পে গ্যাসের দাম এক সাথে প্রায় ২০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। সবমিলেই পণ্যের উৎপাদন দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু যে হারে দাম বেড়ে গেছে, বিদেশী ক্রেতারা ওইহারে তৈরি পোশাকের দাম বাড়ায়নি। সবমিলেই রফতানি আয় কমে যাচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে তেমন সুখকর কিছু না থাকলেও আমদানি ব্যয় সংকোচনের ধারা বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। কারণ, শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, পণ্যের কাঁচামালের যে মজুদ তাদের কাচে ছিল তা ফুরিয়ে আসছে। বিশেষ করে স্টীল, সিরামিক্সসহ অন্যান্য পণ্যের কাঁচামালের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। তাদের যে পরিমাণ কাঁচামাল আমদানির জন্য চাহিদা রয়েছে, আমদানি করা হচ্ছে তা চেয়েও কম। শিল্প কারখানা টিকিয়ে রাখতে হলে বাধ্য হয়ে সামনে তাদের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিতে হবে। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানিতেও বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হচ্ছে।
অন্যদিকে, প্রতিবেশি দেশসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের চিকিৎসার জন্য বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হয়। একই সাথে বিদেশে ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্যও প্রয়োজন হয় বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। সবমিলেই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা দিন দিন কমবে না, বরং বেড়ে যাবে।