ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সদ্য উদ্বোধন কৃত ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অসহনীয় যানজটের রাজধানীতে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিশাল এই অবকাঠামোর ছায়ায় মিশে আছে বে কিছু দুশ্চিন্তা।
এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি র্যাম্প এমন জায়গায় নামানো হয়েছে, যেখানে এখনই সব সময় যানজট থাকে। চালু হওয়ার পর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দ্রুতগতিতে আসা যানবাহন এসব র্যাম্প ধরে মিলবে নিচের সড়কে। ফলে ওই জায়গাগুলোতে যানজট আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা।
১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হয়েছে বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনিরআখড়ায় গিয়ে এর শেষ হবে। এরমধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশ ২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হয়েছে।
মিডনাইট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেছেন। এই এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার জন্য থাকছে ৩১টি র্যাম্প। এসব র্যাম্পের মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। বিমানবন্দর, কুড়িল, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ সরণি, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, পলাশী মোড়, শনির আখড়ায় ১৫টি র্যাম্প ওঠার জন্য এবং বিমানবন্দর, কুড়িল, সেনানিবাস, আর্মি স্টেডিয়াম, শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ আহমদ এভিনিউ, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া, ইন্দিরা রোড, পলাশী মোড়ে নামার জন্য মোট ১৬টি র্যাম্প থাকছে। বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণমুখী যানবাহনগুলো হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, প্রগতি সরণির কুড়িল, আর্মি গলফ ক্লাবের সামনের র্যাম্প দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে। এসব যানবাহন বনানীর কাকলী, মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে এবং ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে নামতে পারবে।
দক্ষিণ দিক থেকে বিমানবন্দরগামী যানবাহন বিজয় সরনি ওভারপাসের উত্তর লেইনের তেজগাঁও টোলপ্লাজা, বিজয় সরণি ওভারপাসের দক্ষিণ দিক দিয়ে টোলপ্লাজা, বনানী রেল স্টেশনের সামনের টোল প্লাজা হয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে। এসব যানবাহন মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, যানবাহন বনানীর কাকলীতে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর মোড়, কুড়িল বিশ্বরোড এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সামনে নামতে পারবে। নগর পরিকল্পনবিদরা বলছেন, বনানীর কাকলী, মহাখালী, বিজয়সরণি ওভারপাস এবং পলাশী মোড়ের র্যাম্প শেষ পর্যন্ত গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৩ সালে পরিকল্পনায় যেসব জায়গায় র্যাম্পগুলো ছিল, নানা ধরনের বাধার কারণে সেখানে হতে পারেনি। কিছু র্যাম্প অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। “বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে র্যাম্পগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। মহাখালীর দুটি র্যাম্প রাওয়া ক্লাবের ওইদিকে হওয়ার কথা ছিল। খামারবাড়ির র্যাম্পটি নিয়ে যাওয়া হয়েছে র্যাংগস ভবনের দিকে। যেহেতু পিপিপি প্রজেক্ট, তাকে অ্যালাইনমেন্ট দিতে হবে। যে জায়গায় পেরেছে, সেখানে নামিয়ে দিয়েছে। এটা আসল প্ল্যান অনুযায়ী হয়নি।
”শামসুল হক বলেন, কাকলী, মহাখালী, বিজয়সরণি ফ্লাইওভার থেকে র্যাম্পগুলো যেখানে নামানো হচ্ছে, সেখানে এখনই যানজট লেগে থাকে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দ্রুতগামী যানবাহনগুলো এসে তা আরও বাড়াবে। “ওই জায়গাগুলোতে স্যাচুরেটেড, ক্রনিক কনজেশন হয়। এসব জায়গায় অতিরিক্ত যানবাহনের আরেকটা স্রোত আসবে। ফলে এখন যেমন বনানী ফ্লাইওভার, গুলিস্তান ফ্লাইওভার, তেজগাঁও ফ্লাইওভার, মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে গাড়ি আটকে থাকে, তেমন থাকবে এক্সপ্রেসওয়েতে। অতএব এসব জায়গায় অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।” ·
ফার্মগেট এবং বিমানবন্দর থেকে আসা যানবাহন বনানীর কাকলীতে এসে নামবে। যানবাহনের একটা অংশ বামদিকে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ হয়ে গুলশানের দিকে যাবে, কিছু বিমানবন্দর সড়কের যানবাহনের সঙ্গে মিলবে। বর্তমানে বিমানবন্দর সড়ক ধরে আসা যানবাহন কাকলীতে সিগন্যালে আটকা পড়ে। এক্সপ্রেসওয়ের যানবাহনের ফলে এখানে যানজট আরও বাড়বে। · মহাখালী বাস টার্মিনালের উল্টোদিকে একটি র্যাম্প এসে নেমেছে। তেজগাঁও থেকে মহাখালীর দিকে আসা সড়কে দূরপাল্লার বাসগুলো যাত্রী নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি পেট্রল পাম্প এবং সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন থাকায় তেল নিতে আসা যানবাহনও সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে। র্যাম্প হয়ে নামা যানবাহনগুলো এই যানজট আরও বাড়াবে। · রাজধানীর বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ওভারপাসে দুই প্রান্তেই দিনের বেশিরভাগ সময় যানজট লেগে থাকে। এই ওভারপাসের দুদিক থেকে দুটি র্যাম্প উঠেছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। ওভারপাস থেকে র্যাম্পে ওঠার সময় যানবাহনগুলোকে সড়কের একপাশে আসতে হবে। এছাড়া এ সময় যানবাহনরে গতিও কমাতে হবে। র্যাম্পে উঠেই টোলপ্লাজায় যানবাহনকে দাঁড়াতে হবে। অপেক্ষমাণ যানবাহনের সংখ্যা বেশি হলে তার প্রভাব পড়বে ওভারপাসে।
কারওয়ানবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছ থেকে সোনারগাঁও হোটেল, পান্থকুঞ্জ, হাতিরপুল, কাঁটাবন হয়ে একটি র্যাম্প চলে যাবে পলাশী মোড় পর্যন্ত। সেখান থেকে যানবাহন র্যাম্প হয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে। একইভাবে এখানে এসে নামতেও পারবে। পলাশী এলাকায় রিকশা, ছোট যানবাহনের ভিড় থাকে সারাদিন। ফ্লাইওভারের যানবাহনগুলো এখানে এসে আরও যানজট বাড়াবে। নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়েছিল যানবাহনকে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় র্যাম্প নামানো হচ্ছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। “
বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে তুলবে, তাদের আয় বাড়বে। যেখানে র্যাম্পগুলো নামানো হচ্ছে সেখানে যানজট তৈরি হবে। হানিফ ফ্লাইওভারে এটা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে, গুলিস্তানে নামার আগে যানবাহনগুলো দীর্ঘ সময় যানজটে থাকে।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমানও মনে করছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর তাতে যানবাহন ওঠানামার কারণে নিচের সড়কে প্রভাব পড়বে। প্রাথমিকভাবে তারা এরকম কিছু জায়গাও চিহ্নিত করেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা কিছু জায়গা নিয়ে পর্যালোচনা করেছি, আরও কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলো রিভিউ হবে, টোটাল অ্যাসেসমেন্ট করে তারপর আমরা তা সেতু বিভাগকে জানাব।” মুনিবুর রহমান বলেন, “অ্যাসেসমেন্ট করে ট্রাফিক মুভমেন্ট রেশনিং করা হবে। কোনটাকে কতটা প্রায়োরিটি দেওয়া হবে সেটা ঠিক করে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করব।”
আপত্তি দুই সিটি করপোরেশনেরঃ
গত ৮ মে ঢাকা যানবাহন পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের এক বৈঠকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি র্যাম্পের কারণে যানজট আরও বাড়বে বলেই তাদের ধারণা। ঢাকা মহানগরীতে চলমান সড়ক, রেল ও নৌ পরিবহন অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য গঠিত কমিটির সভা ছিল সেদিন। ওই সভার কার্যপত্রে দেখা যায়, সেদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক ও রেল অ্যালাইনমেন্ট হয়ে শহরের বাইরে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে র্যাম্প নামানো হচ্ছে, এতে শহরের ওপর যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। এফডিসি রেলক্রসিং হয়ে পান্থকুঞ্জ পার্কে এবং আরেকটি র্যাম্প হাতিরপুল হয়ে পলাশী পর্যন্ত যাবে। এতে একদিকে পান্থকুঞ্জ পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পলাশী এলাকায় যানবাহনের চাপ বাড়বে। তখন পদ্মা সেতুগামী যানবাহন পলাশী হয়ে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে উঠতে চাইবে।সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, কাকলী ইন্টারসেকশনের কাছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র্যাম্প ঢাকা-ময়মনসিংহ প্রধান সড়কের কাছে কাকলী ইন্টারসেকশনের কাছে নামানো হবে। এতে এখানে যানজট বেড়ে যাবে। বিষয়টি সমাধানের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে উত্তর সিটি করপোরেশন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএমএস আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব জায়গায় আপত্তি তা আছে তা ‘পুনর্বিবেচনা’ করছেন তারা। “পলাশী এবং পান্থকুঞ্জের র্যাম্প নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি আমরা। কাকলীতে র্যাম্প থেকে যানবাহন নেমে যাওয়ার জন্য আলাদা লেইন করে দিয়েছি। গাড়িগুলো নেমে দুদিকে চলে যাবে। ফলে এখানে যানজট হবে না।” তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলছেন, র্যাম্প নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যে আপত্তি জানিয়েছিল, সেখান থেকে তারা সরে আসেননি। “পান্থকুঞ্জ পার্কটি সংরক্ষণ করতে হবে। তাছাড়া সেখানে একটি বক্স কালভার্ট রয়েছে, যেটা দিয়ে ঢাকার একটা বড় অংশের পানি আসে। র্যাম্পের জন্য ওই কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত করা মানে হচ্ছে জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা। এ বিষয়টি আমরা উপস্থাপন করেছি।”
(এই সংবাদটি গত ৩১শে আগষ্ট'২৩ এ বহুল প্রচারিত বিডিনিউজ২৪ডটকম(ট্রান্সকম গ্রুপ) পত্রিকায় ছাপা হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে পত্রিকাটি অনলাইন থেকে গায়েব হয়ে যায়)