ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও আজারবাইজান এবং গুয়েতেমালার বিরুদ্ধে পৃথক প্রস্তাব পাস হয় ইইউ পার্লামেন্টে। যৌথ প্রস্তাবে নাগরিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণে ৩ দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পার্লামেন্ট প্রচারিত বিবৃতিতে এমইপিরা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে সরকারের প্রতি এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা এবং কর্মী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেনে চলতে হবে। সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো যেন বিদেশি অনুদান গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে বিশেষভাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দুই নেতা আদিলুর রহমান খান এবং এএসএম নাসিরুদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশের নিন্দা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি অবিলম্বে তাদের নিঃশর্তভাবে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) সুবিধা আরও বর্ধিত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এমন অবস্থায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা বলেন, অধিকারের সঙ্গে যে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছে তা পশ্চাদগামী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা।
মোটা দাগে ৩ (উপ-দফা ১০) দফা সম্বলিত প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। কণ্ঠ ভোটে নিরঙ্কুশভাবে পাস হওয়া রেজ্যুলেশনে যে ৩ ধারা এবং ১০ উপধারা রয়েছে তার প্রথমেই বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বলপূর্বক গুম, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত হওয়াসহ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটেছে। ‘অধিকার’ নামের একটি নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিবন্ধন বাতিল করাসহ নানামুখী হয়রানির শিকার হচ্ছে। অধিকারের দুই নেতা আদিলুর রহমান খান এবং এএসএম নাসিরউদ্দিন এলানকে সাজানো ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করা হয়েছে। মামলা পরিচালনায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, যা নিয়ে প্রশ্ন এবং ব্যাপক নিন্দার ঝড় উঠেছে। সেখানে জাতিসংঘ সংস্থা এবং মানবাধিকার হাইকমিশনার নিন্দা করছে যে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের বিচার বিভাগ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভয় দেখানো এবং হয়রানির জন্য এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এ অবস্থায় জরুরি হচ্ছে- ১. বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা। এনজিও, হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার এবং অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য সরকারকে একটি নিরাপদ এবং সক্ষম পরিবেশ পুনরুদ্ধার এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার সমুন্নত রাখা। বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলা।
২. ১৪ই সেপ্টেম্বর অধিকারের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয়েছে তা বাতিল এবং তাদের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়া এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো যাতে অনুমোদিত বিদেশি অনুদান পেতে পারে তার পথ সুগম করা।
৩. জাতিসংঘের সঙ্গে মিলে কোনো একটি স্পেশাল ম্যাকানিজম বের করতে সরকারকে উৎসাহিত করা যাতে বলপূর্বক গুমের অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপঙ্খভাবে তদন্ত করা যায়। সেই সঙ্গে গুমের কেসগুলোর শুনানি চলাকালে আদালতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হয়।
৪. বাংলাদেশের জন্য ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) সুবিধা আরও বর্ধিত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এমন অবস্থায় অধিকারের সঙ্গে যে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছে তা পশ্চাদগামী পদক্ষেপ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা তা বিবেচনা করা।
৫. ২০২৩ সালের জুনে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলামের সহিংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
৬. কোর ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রম বিষয়ক রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো।
৭. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি ফের আহ্বান এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণে উৎসাহিত করা।
৮. বিরোধী প্রতিনিধিদের গণগ্রেপ্তার এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য এখনই সরকারকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ওই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
৯. ইউরোপীয় এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিস, ইইউ প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে থাকা ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাস এবং তাদের প্রতিনিধিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিয়মিতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ এবং স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক যারা হয়রানি বা হামলার শিকার তাদের পাশে পূর্ণ সমর্থন নিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান।
১০. রেজ্যুলেশনটি কমিশন, কাউন্সিল, কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বিদেশের জন্য ইউনিয়নের উচ্চ প্রতিনিধি, নিরাপত্তা বিষয়ক নীতি প্রণয়নকারী এবং বাংলাদেশ সরকার ও এ দেশের সংসদে ফরওয়ার্ড করার আহ্বান।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যা বললেন জোসেপ বোরেলঃ
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইইউ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের জনগণ যে বিপুল উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তা স্বীকার করে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংকীর্ণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার শ্বাসরোধ এবং মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নেতাদের মতো রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে বাধার বিষয়েও অবগত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের প্রতিবেদনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে জাতিসংঘ যে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তা সমর্থন করে। জোরপূর্বক গুম বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের সফরেও বাংলাদেশের অনুমতি দেয়া উচিত বলে জানান বোরেল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমস্ত অংশীদারদের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছে। ওই নির্বাচনকে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ। ভোটারদের স্বাধীনভাবে তাদের ভোট দেয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরি করতে সকল প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতার মতো প্রধান স্বাধীনতাগুলোর অধিকার রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হলো জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির চাবিকাঠি। এমন একটি সমাজ তৈরি করতে হবে যেখানে কেউ নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতির সমালোচনা করতে ভয় পায় না।
জোসেপ বোরেল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নের মতো ইস্যুতে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে তার স্থান খুঁজে নিয়েছে। বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ১৬০ ভোট পেয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে যোগদান করে। এশিয়ার আর কোনো প্রার্থী দেশগুলো এত ভোট পায়নি। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ মানবাধিকারের মান বজায় রাখার দায়িত্বও কাঁধে