ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে কে নির্বাচনে এল, কে এল না, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ব্যাপকসংখ্যক ভোটার ভোট দিলেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ইসি নির্বাচনের লিগ্যালিটি (আইনগত দিক) দেখবে, নির্বাচনের লেজিটিমেসি (বৈধতা/ন্যায্যতা) নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’
সিইসি বলেন, ‘যদি এক শতাংশ ভোট পড়ে এবং ৯৯ শতাংশ নাও পড়ে, আইনগতভাবে নির্বাচন সঠিক হবে। লেজিটিমেসির ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আইনত নির্বাচন সঠিক হবে। লেজিটেমেসি নিয়ে ইসি মাথা ঘামাবে না। ইসি দেখবে, ভোটটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে— এক শতাংশও যদি ভোট পড়ে এবং ভোটার যারা আসছে, তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি, তাদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে, তারা নির্বিঘ্ন ও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।’
বুধবার ‘অবাধ ভোটাধিকার, প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় সমাপনী বক্তব্যে সিইসি এসব কথা বলেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সিইসির সভাপতিত্বে এ কর্মশালায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিসহ বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য দেন। তবে সাবেক সিইসি ড. শামসুল হুদা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানালেও শেষ পর্যন্ত তিনি অংশ নেননি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে ৬৪ জেলায় নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বড় পর্দার মাধ্যমে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন।
বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত করে সিইসি বলেন, “কাউকে নির্বাচনে নিয়ে আসা ইসির দায়িত্ব নয়। তবুও নৈতিকতার অবস্থান থেকে অনেকবার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আসুন, আমাদের সঙ্গে চা খান। ডিও লেটার পর্যন্ত লিখেছি। এর বেশি আমরা করতে পারছি না।”
এ সময় সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টসহ রাজনীতিকদের নির্বাচনের ছয় মাস আগে বা নির্বাচনের পরে গ্রেপ্তার করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সৎভাবে ভোট করতে চাচ্ছি। কোনো দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। সেজন্য আমরা সরকারকে এটা জানাব যদি তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে হয় ছয় মাস আগেই সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলেন। আর যদি না করেন তবে নির্বাচনের পরে গ্রেপ্তার করে ফেলেন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক হবে না। এতে আমরা কলঙ্কিত হবো বলে মনে করি। পোলিং এজেন্ট না থাকলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
সিইসি আরও বলেন, ‘নির্বাচনগুলো প্রতিযোগিতামূলক হলে ইসির দায়িত্ব অনেক কমে যায়। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ইসির অল্প একটু রেফারির ভূমিকা থাকবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোই তাঁদের অবস্থানটাকে সুদৃঢ় রাখবে। কার্যকর প্রতিযোগিতা হলে ভোট কেন্দ্রের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন ইসির দায়িত্ব কমে আসে। ইসি দেখতে চায়, নির্বাচনের দিনে ভোটাররা এসেছেন। তারা লাইনে দাঁড়িয়েছেন। ভোটকেন্দ্রে ঢুকছেন।’
একই দিনে ৩০০ আসনে ভোটগ্রহণের বিপক্ষে মত দিয়ে সিইসি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৪২ হাজার কেন্দ্রে একদিনে ভোট করা খুবই কঠিন। উপস্থিত সবাইকে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের চিন্তার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই চিন্তার বিষয়টি আপনাদের। এটা হলে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’
সংলাপ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবাই বলে থাকেন, সংলাপের মাধ্যমে একটা সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার কথা। কমিশনও বলেছে, সংলাপের মাধ্যমে সমাঝোতা করে যদি একটি অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠতো। তাহলে আমাদের জন্য কাজটা সহজ-সাধ্য হতো।’
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘কেউ শব্দটা ব্যবহার করছেন পারটিসিপেটরি, কেউ ব্যবহার করছেন ইনক্লুসিভ।’ পারটিসিপেটরি ও ইনক্লুসিভের অর্থ কী এটি নিয়ে তিনি কনফিউশনে পড়েছেন জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘কমিশন ইনক্লুসিভ নির্বাচন লাইক করে, কাউকে নিয়ে আসা ইসির দায়িত্ব না। যদি ওয়ান পারসেন্ট ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে। লিগ্যালি দ্যাট ইজ রাইট। কোশ্চেইন অব লেজিটিমেসি মে অ্যারাইজ। বাট দি কোশ্চেইন অব লিগ্যালিটি উইল নট অ্যারাইজ। সো দেয়ার ইজ এ কনফ্লিক্ট বিটুইন লিগ্যালিটি অ্যান্ড লেজিটিমেসি।’
তিনি বলেন, ‘আইনগত দিক থেকে লিগ্যালিটি আর লেজিটিমেসি। লিগ্যালি একটা জিনিস হলে লিগ্যালি ভ্যালিড। বাট লেগেলিমেসি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যেখানে পারসেপশন তৈরি হয়। আমি ওই বিরোধে যেতে চাচ্ছি না। নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করবে একটি ল’ফুল নির্বাচন করতে। আর রাজনৈতিক সমাজ লেজিটিমেসি নিয়ে ফাইট করবে। নির্বাচন কমিশন এই বিষয় নিয়ে ফাইট করবে না।’
নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর প্রসঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করে সিইসি বলেন, ‘তাঁরা নিজেরা এসেছে, নাকি অবস্থাটা সৃষ্টি করে দিয়েছি। এভাবে আমেরিকা, বিলেত এসে কথা বলছে- এ জন্য আমি খুব গর্ববোধ করি না।’
দেশের সুশীল সমাজ বিভক্ত থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেন সিইসি বলেন, ‘সিভিল সোসাইটিও পলিটিক্যালি সার্ফলি ডিভাইডেড। এটা দু:খজনক। এমন কোনো দুচারটি সিভিল সোসাইটি গড়ে তুলতে পারেনি যারা সর্বজন শ্রদ্ধেয়, নিমোর্হ থেকে, পক্ষপাতিত্বহীনভাবে দেশ ও জাতির জন্যে কাজ করতে পারে। হয়ত পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে প্রত্যাশিত সিভিল সোসাইটি হয়েছে।’
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘নির্বাচনে আমরা কী এমন করেছি যে আমাদের ওপর আস্থা আনা যাচ্ছে না। অনেককে বলতে শুনেছি আমরা নাকি লোক দেখানো কাজ করছি। আসলে আমাদের কাজ হচ্ছে জাল ভোটার থাকবে না। অবাধ ও উৎসমুখর ভোট করা। জনগণ যাকে ভোট দেবে সে নির্বাচিত হবে। আমাদের কোনো চাওয়া নেই। তারপরও আমাদের ওপর অনেকে আস্থা রাখতে পারছে না।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের অন্যতম সদস্য মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে ইসির ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচন নিয়ে তারা যখন আপোস করতে পারবেনা তখন মারামারি ছাড়া আর কোনো গত্যান্তর নেই।’
কে এম নূরুল হুদা কমিশনের অন্যতম সদস্য কবিতা খানম বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক ভোট নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক ভোট নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। সব দলকে ভোটে আনা এটা ইসির দায়িত্ব নয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পায় না।’
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, ‘ভোট অবাধ করতে সবাইকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভালো ভূমিকা নিতে হবে। ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে বেস্ট’ এমন মন্তব্য করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আওতায় ৯০০-এর বেশি নির্বাচন হয়েছে। সব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। সরকারও নির্বাচনে ইন্টারফেয়ার করেনি, বরং সহযোগিতা করেছে। বর্তমান কমিশন বিজ্ঞ। অথচ বিএনপি-জামায়াত কমিশনের পদত্যাগ দাবি করছে। জামায়াতকে বহু আগে থেকে নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল। তারা নির্বাচন কমিশন ও সরকার মানে না। সরকারের জন্য এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জ। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এবার তার প্রমাণ দিতে হবে।’
সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কোনো সমস্যা নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও ইসিকে সহযোগিতা না করে তবে সুন্দর নির্বাচন করা তাদের পক্ষে কঠিন।’
একুশে টিভির সিইও পীযুষ বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকেই দোষ দিলে চলবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনে সুশীল সমাজ, শিক্ষক ও বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদেরও ভূমিকা রাখা দরকার। দেশের তরুন সমাজ এখন ভোট দিতে চান না। তাদেরকে ভোটের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এর সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামীম রেজা, গ্লোবাল টিভির সিইও সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ডিজি আসাদুজ্জামন আরজু প্রমূখ।