ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জাতিসংঘ ছাড়া অন্য কারও নিষেধাজ্ঞা আমলযোগ্য নয়- এমন মন্তব্য করে ঢাকাস্থ রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি বলেছেন, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই রাশিয়া অবস্থান নবে। আমরা বরাবরের মতো বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবো।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম আয়োজিত ‘টকস উইথ অ্যাম্বাসেডর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম। সঞ্চালনা করেন বাংলা ট্রিবিউনের কূটনৈতিক রিপোর্টার শেখ শাহরিয়ার জামান। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমারা সরব থাকলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা নিয়েছে এমন অভিযোগ করে অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ইউক্রেনে মানুষের মৃত্যু নিয়ে তারা ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। অথচ এটা নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। রাষ্ট্রদূত বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে রাশিয়া ও বাংলাদেশের পজিশন একই।
এক প্রশ্নের জবাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, স্যাটেলাইট স্থাপনে বাংলাদেশ সরকার যে দেশকে ভালো অংশীদার মনে করবে, তাকেই বেছে নেবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া যে অবদান রেখেছিল, সেই অবদান কোনোভাবেই পরিশোধ করা যাবে না। বর্তমান ভূ-রাজনীতিতে আমাদের পক্ষে রাশিয়াকে প্রয়োজন।
যেকোনো নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে থাকবো, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়: রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমরা পশ্চিমের যেকোনো অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। আমরা শুধু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা হলে সেটিকে স্বীকৃতি দেই। যদি বাংলাদেশে ওই ধরনের কোনো সমস্যা হয়, তাতেও ভয়ের কিছু নেই। আমরা পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করে নেবো এখানে কী ধরনের সহযোগিতা লাগবে? রাশিয়ার সরকার এবং অন্যান্য ইনস্টিটিউশন মিলে আলোচনা করে আমরা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি পন্থা বের করবো। আমরা এখানে (বাংলাদেশে) যেকোনো নিষেধাজ্ঞা বা অনুরূপ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে থাকবো। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে না এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, আপনারা (সাংবাদিকরা) জিজ্ঞাসা করছেন রাশিয়া কী করবে, কিন্তু আমরা এখনো জানি না বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত ইতিবাচক জবাব দেন। তিনি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার কথা উল্লেখ করেন।
গত ২২শে নভেম্বর এক সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মারিয়া জাখারোভা বলেছিলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার অজুহাতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের প্রচেষ্টার বিষয়ে বারবার কথা বলেছে রাশিয়া। জাখারোভাকে উদ্ধৃত করে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, জাতীয় আইনের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে, বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য ছাড়াই আগামী ৭ই জানুয়ারি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। ২০২২ সালে বাংলাদেশে রাশিয়ান মহাকাশ শিল্পের পণ্য ও পরিষেবার প্রচারের ক্ষেত্রে সহযোগিতার একটি স্মারক সই করেছে রাশিয়ান জেএসসি ‘গ্লাভসকমস’ এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড। যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট সিস্টেমের উৎপাদন ও উৎক্ষেপণের বিষয়গুলো রয়েছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রকল্পের প্রযুক্তিগত পরিমিতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য বাণিজ্যিক প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশ সরকারের উপর নির্ভর করছে, এখন তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব। ২০২৩ সালের নভেম্বরের শুরুতে রাশিয়ান প্রশান্ত মহাসাগরীয় বহরের একটি বিচ্ছিন্ন যুদ্ধজাহাজ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌ অংশীদারিত্ব জোরদার করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে শুভেচ্ছা ভ্রমণ করেছিল। বিষয়টি নিয়ে কোনো গোপন বার্তা আছে কিনা? জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ভ্রমণ। আপনারা এটিকে কীভাবে দেখবেন তা আপনাদের ওপর নির্ভর করে, তবে এটি একটি শুভেচ্ছা সফর ছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশ রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তিনি বলেন, এমনকি কোভিড-১৯ মহামারিও একে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। ২০২১ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৯৭ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড গড়েছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, ২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘বেআইনি’ একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পরে উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাংলাদেশসহ বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে বাণিজ্য লেনদেন ৬৪০ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
তিনি বলেন, রুশ কোম্পানিগুলো জি-টু-জি ভিত্তিতে ১ মিলিয়ন টন শস্যের পাশাপাশি প্রতি বছর ৫ লাখ টন পটাশিয়াম ক্লোরাইড সরবরাহ করতে প্রস্তুত। রাষ্ট্রদূত বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সম্পৃক্ততা শুধু নির্মাণকাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আমরা পারমাণবিক প্রকল্পের পুরো জীবনচক্র জুড়ে আমাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের সহায়তা করবো। যার মধ্যে চুল্লির জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ, উদ্ভিদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাশিয়া বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক সেক্টর তৈরি করতে সহায়তা করছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার পূর্ণ সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। এখন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে, ২০২২ থেকে অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই রাশিয়ান ব্যবসায়ীরা নতুন সরবরাহকারীদের দিকে মনোযোগী হচ্ছে, এর মধ্যে বাংলাদেশের সরবরাহকারীরাও রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিনিয়োগেই বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে। তিনি বলেন, রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আইসিটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, মহাকাশ ও ভূতাত্ত্বিক গবেষণা, মেরিটাইম, রেলওয়ে ও বিমান পরিবহনের মতো খাতে বিভিন্ন যৌথ প্রকল্পে অংশ নিতে প্রস্তুত। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, এসব বিষয় নিয়ে রাশিয়া-বাংলাদেশ আন্তঃসরকারি কমিশন অন ট্রেড, ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশনের পঞ্চম বৈঠকে আলোচনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, আমরা ২০২৪ সালে এ বৈঠকে মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা করছি।