DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

তারল্যের মহা সংকট! চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি!

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আগামী ৭ই জানুয়ারি পাতানো একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই পাতানো নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতি এখন নানা ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ডলার সংকট। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ে ধীরগতি। খেলাপি ঋণের ভারে বিশৃঙ্খল আর্থিক খাত। চরম তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত।

দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে বেশির ভাগই ধারদেনা করে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছে। এত বেশি ব্যাংকের টাকা ধার করার নজির নেই। আবার পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ১৪ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রেকর্ড করেছে।

পুঁজিবাজারেও চলছে মন্দাভাব। বিনিয়োগে স্থবিরতা। আমদানি এখন নিয়ন্ত্রিত। ওদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের নির্দিষ্ট, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাপনকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। সবমিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন কঠিন সময় দেশের অর্থনীতি আগে কখনো দেখেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি, দুর্বল মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, খেলাপি ঋণ, সুদহারের সীমা, অত্যাবশ্যকীয় আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ, দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি। তাই দেশের অর্থনীতির ধারা বজায় রাখতে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আগামী জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা উঠে আসছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে, যার কারণে তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় এক প্রকার হিমশিম খাচ্ছে।

এসব বিষয় নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতি এখন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টের চাপ আছে, রিজার্ভের চাপ আছে। আবার মূল্যস্ফীতির চাপও আছে। ফলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা অস্থির অবস্থায় পার করছি। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া শ্রমিক ও মানবাধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয়দের একটা চাপও আছে। এসব ইস্যু একসঙ্গে হওয়াতে অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়েছে।

তারল্য সংকট: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণও বাড়ছে। গত বুধবার সংকটে থাকা বিভিন্ন ব্যাংক রেকর্ড ২৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার নিয়েছে। এর আগে গত ২৫শে অক্টোবর সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেয়ার রেকর্ড ছিল। গত বুধবার পর্যন্ত ধারের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।

সুদ হার: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক কলমানিতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। কলমানির সুদের হার ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার কলমানিতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যার গড় সুদহার ছিল ৯.১৪ শতাংশ। গত বুধবার এ ধারের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, যার গড় সুদহার ৯.১৩ শতাংশ।

ঋণের সুদের হার: ব্যাংকে ঋণের সুদের হার বাড়ছে। আগে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। এখন তা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যেও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ আসবে।

খেলাপি ঋণে রেকর্ড: চলতি বছর খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয়েছে দেশের ব্যাংক খাতে। জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০.১১ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

এদিকে বিশ্বব্যাংক জানায়, ১২ বছরে বাংলাদেশের ঋণ আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে। আর গত বছরে বেড়েছে ৬.৫৯ শতাংশ।

৫ ইসলামি ব্যাংকের লেনদেন বন্ধের উপক্রম: শরীয়াহভিত্তিক পরিচালিত পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক। সরকার দেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়, এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ১৪টি ব্যাংক রেকর্ড মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতির ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ ঘটনা। এর আগে ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির ঘটনা ঘটেছিল।

ডলার সংকট: ডলারের দামে লাগাম টানা হয়েছে। যদিও বাজারে খুব একটা প্রভাব নেই। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ডলারের দাম তিন দফায় কমানো হয়েছে। ফলে এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে। আগে ছিল ১১১ টাকা। মাঝে অস্থিরতায় খোলাবাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৭ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর। তবে এখনো মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডলার সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা করে বিক্রি করার কথা থাকলেও ১২২ টাকার নিচে তাদের কাছে ডলার মিলছে না।

রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে: চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৪.৩৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ২.০৩ শতাংশ। রেমিট্যান্সের প্রবাহ আগামীতে কমে যেতে পারে। এদিকে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার হতে পারে।

রিজার্ভ সংকট: চলতি মাসে আইএমএফের ঋণ বাবদ ৬৯ কোটি ডলারসহ তিনটি সংস্থার ১৩১ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় সামান্য বেড়েছে দেশের রিজার্ভ। তবে জানুয়ারিতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দেনা শোধ করলে রিজার্ভ আবার কমে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫.৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে খরচ করার মতো রিজার্ভ (বিপিএম৬) আছে ২০.৪১ বিলিয়ন ডলার।

রপ্তানি আয়: রপ্তানিতে নিম্নমুখিতা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছিল ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ১.৩০ শতাংশ। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আগামীতে রপ্তানিতে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

আমদানি ব্যয়: গত জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৪.১৮ শতাংশ। এলসি খোলা বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতে। জানুয়ারিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি আরও কমতে পারে বলে পূর্ভাবাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কমছে। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম হওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এমন কোনো কর্মসূচি যেন না আসে যাতে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে যাবো বলে বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুব আলম। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!