ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নানামুখী চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনা, নৌকা প্রতীকের বিজয়, নির্বাচনের দিন সংঘাত এড়ানো, নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া ও সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দলটির পক্ষ থেকে এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা শীর্ষ কয়েক নেতার মাধ্যমে ওইসব
নির্দেশনা দেন। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা জানা গেছে। এর মধ্যে দলটির প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনা। গত ক’দিন ধরে তারা এ নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে প্রচারণা চালিয়েছেন। ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটের উপস্থিতি হলে আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকে বাঁকা চোখে দেখবে না- এমন প্রচারণাও চালানো হয়েছে।
দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি জেলায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। সেখানে বারবার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি তার প্রার্থীদেরও একই বার্তা দিয়েছেন।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের তিনি বলেন, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইতে হবে। তাদেরকে ভোটকেন্দ্রে আনতে হবে। কারণ এবারের নির্বাচনে যে বেশি জনপ্রিয় সেই-ই নির্বাচিত হবে। আওয়ামী লীগের সামনে এবারের ভোটে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে নৌকা প্রতীকের বিজয়। প্রথমবারের মতো দলীয় নেতাদের নির্বাচনে উন্মুক্ত করে দেয়ায় এবার প্রায় প্রতিটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি। দেশের অপর বৃহৎ দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় নিজ দলের নেতাদেরই মোকাবিলা করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। এ নিয়ে দেশের শতাধিক নির্বাচনী এলাকায় নৌকা প্রতীক ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক ও ঈগলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কয়েকজনের প্রাণহানিও হয়েছে। বেশির ভাগ নির্বাচনী আসনে দলীয় কোন্দল স্পষ্ট হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভক্ত। অনেক আসনে দেখা গেছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতীকের জন্য প্রচারণা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এরকম একটি উদাহরণ দেখা গেছে দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরে। সেখানে নৌকা প্রতীক পাওয়া জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের জন্য নৌকার অফিস তৈরি করে তার প্রচারণা চালিয়েছেন একাধিক নেতা। কিন্তু কয়েকদিন আগে সেইসব নেতারা নৌকার অফিসকে পরিবর্তন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রফেসর আবদুল মান্নানের সঙ্গে হাত মেলান। এ চিত্র দেখা গেছে দেশের আরও অনেক নির্বাচনী আসনে। দলটির তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে নির্বাচনের দিন সংঘাত এড়ানো। দেশের অর্ধশতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরা রয়েছেন। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা। এসব আসনে নির্বাচনের দিন সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে বলে একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতা।
তারা জানান, প্রতীকের বিভক্তি এখন ব্যক্তি পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ আছেন দলীয় প্রতীক নিয়ে আবার কেউ আছেন অমুক ভাইকে নিয়ে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে দলীয়ভাবে এ নিয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একাধিকবার সংশ্লিষ্ট নেতাদের সতর্ক করা হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়া যাবে না। দলটির চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া।
দলটির নেতারা জানান, নির্বাচনের আগে যেসব আসনে নানা কারণে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেসব আসনে নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ভোটকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পঞ্চম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির এক আসন থেকে একাধিক নেতা ভোটে অংশ নিয়েছেন। যারা অংশ নিয়েছেন তাদের বিক্ষিপ্তভাবে সমর্থন দিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এতে সাংগঠনিক ঐক্য নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। ভোটের পর ওই পরিস্থিতির লাগাম টানতে হবে বলে জানান তারা। দলীয় নেতাদের মতে- এই চ্যালেঞ্জটা মেটাতে সাংগঠনিকভাবে হিমশিম খেতে হতে পারে আমাদের। নির্বাচনের পর দলের প্রথম দায়িত্ব হবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতা মানবজমিনকে বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ কারণে দলীয় সভাপতি এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব নির্দেশনা না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দলীয় নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন- যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। কোনো প্রার্থী জয়ী হওয়ার জন্য কারচুপির আশ্রয় নিতে পারবে না, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারবে না, জালভোট দিতে পারবে না। যদি এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সেটি যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে আজীবন দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এমনকি তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নির্দেশনায় তিনি আরও বলেন, কোনো অবস্থাতেই কোনো প্রার্থী যেন জালভোট না দেয়, কোনো ভুয়া ভোট না দেয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। আওয়ামী লীগ সরকার এবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়।
দলটির নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন যে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, নির্বাচন কমিশন স্বীয় বুদ্ধি বিবেচনা করে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে। কাজেই নির্বাচন কমিশনই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে। তাই নির্বাচন কমিশনের কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনকে বাধা দেয়া যাবে না এবং নির্বাচন কমিশনকে অসহযোগিতা করা যাবে না।