ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে সরকারের সমালোচনা করার জন্য লোকদের গ্রেপ্তার করে ভিন্নমতকে দমন করেছে। একইসঙ্গে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ তার ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০২৪-এ একথা বলেছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না এই বিশ্বাসে প্রধান বিরোধী দলগুলি ভোট বর্জন করেছিল। নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, জুলুমবাজি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হুমকির সাক্ষী থেকেছে শরণার্থী শিবিরগুলিও। যেখানে ১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস, যারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেননি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, “বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের উচিত তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার শর্ত হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য জোর দেয়া।গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতার অভাব একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কৃতিকে উস্কে দিচ্ছে যেখানে বাংলাদেশীরা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অথবা ঘুষ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নিহত বা গুম হওয়ার ভয় পান।"
৭৪০ -পৃষ্ঠার ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০২৪- এর ৩৪ তম সংস্করণে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। তার সূচনামূলক প্রবন্ধে, নির্বাহী পরিচালক তিরানা হাসান বলেছেন, ২০২৩ শুধুমাত্র মানবাধিকার দমন এবং যুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্যই নয় বরং সরকারী ক্ষোভ এবং লেনদেনমূলক কূটনীতির জন্যও উল্লেখযোগ্য বছর ছিল যেখানে এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত নয় তাদেরকেও গভীর মূল্য চোকাতে হয়েছে । কিন্তু এর পাশাপাশি 'আশার আলো' ছিল বলেও মনে করেন তিরানা। সরকারকে তাদের মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতাগুলি ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখার আহ্বান এক ভিন্ন সম্ভাবনার পথ দেখায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ৮,০০০ এরও বেশি নেতা ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে প্রতিযোগিতায় তাদের অক্ষম করার জন্য এবং বিরোধী নেতাদের অংশগ্রহণকে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য।
পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে কয়েকদিন বা সপ্তাহ বেআইনিভাবে আটকে রেখে শেষ পর্যন্ত যখন আদালতে হাজির করে তখন অনেকে "নিখোঁজ" ছিলো বলে অভিযোগ।
বাংলাদেশী মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, নিরাপত্তা বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬০০টিরও বেশি জোরপূর্বক গুম করেছে এবং প্রায় ১০০ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে।মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরাও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন। মার্কিন সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-কে (একটি সশস্ত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাখার পর জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
মানবাধিকার রক্ষকরা আটক, নজরদারি এবং হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ঢাকা-ভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ অধিকারের আদিলুর রহমান খান এবং এএসএম নাসিরুদ্দিন এলানকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগের উপর ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদন করার জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। যদিও গত অক্টোবরে তাদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, তবে প্রসিকিউশন তাদের কঠোর সাজা চেয়েছে।
সাংবাদিকরা তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জেরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন এবং নির্বাচন-পূর্ব বিক্ষোভে কয়েক ডজন আহত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৩, যা ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (DSA) প্রতিস্থাপন করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে প্রবর্তিত হয়েছিল, সেখানেও একইরকম আপত্তিজনক উপাদান বিদ্যমান।
DSA-এর অধীনে শতাধিক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করতে এবং সরকারের সমালোচকদের শাস্তি দিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আতিথেয়তা অব্যাহত রেখেছে, যদিও তারা একটি পাইলট প্রকল্প মারফত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের ওপর চাপ দিচ্ছে । সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে কর্তৃপক্ষ কেবল সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং জীবিকা, জীবনধারণ এবং শিক্ষার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে প্ররোচিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য ধার্য রেশন প্রতি মাসে ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে প্রতি মাসে মাত্র ৮ ডলার করা হয়েছে, যা তাদের ক্ষতিকারক স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিণতির দিকে পরিচালিত করে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরিত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা ওষুধ ও খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ এবং শিবিরে প্রতিকূল পরিস্থিতির জেরে শত শত শরণার্থী সুরক্ষার খোঁজে বিপজ্জনক নৌকা ভ্রমণে পাড়ি দিচ্ছেন ।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলছেন, একদিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আতিথেয়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়োচ্ছে , অন্যদিকে শিবিরে তাদের বসবাসের পরিবেশকে অযোগ্য করে তুলছে। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জরুরিভাবে তহবিল বাড়াতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের উচিত তার সীমানার অভ্যন্তরে সমস্ত শরণার্থীদের জন্য কাজ এবং শিক্ষার অ্যাক্সেস প্রদানের প্রতিশ্রুতি পালন করা।