ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভোটের পর হঠাৎ করেই বেড়েছে চালের দাম। যদিও এখন বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। মাসখানেক আগে বাজারে আমন ধান আসায় এখন চালের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোই উল্টো। ১০ দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে চালের দাম। হঠাৎ এমন দাম বাড়ানোয় মিলারদের কারসাজিকে দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা। এই দায় অস্বীকার করে মিলাররা বলছেন, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে দাম। এ ছাড়া আবহাওয়ার কারণেও চালের দাম বাড়ছে বলেও দাবি করেন তারা। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার অবশ্য মজুতদারির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যারা ধান স্টক করছে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।
হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়তে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে চারটি তদারকি দল মাঠে নামায় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তারা বিভিন্ন এলাকায় ওএমএসের ট্রাক ও দোকানে পরিদর্শনের পাশাপাশি বাজারও পরিদর্শন করে। গতকাল বাবু বাজার, কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও নিউ মার্কেটে তারা তদারকি করে। তবে এসব বাজারে কোনো চালের দাম বৃদ্ধিতে কোনো অনিয়ম দেখা যায়নি উল্লেখ করে তদারকিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে চালের কোনো মজুত পাওয়া যায়নি। তাদের ক্রয়কৃত মূল্য ও বিক্রয়মূল্য তালিকা স্পষ্ট করে উল্লেখ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খুচরা বিক্রেতারা মিলারদের কারসাজির কথা উল্লেখ করেছেন বলেও জানান তদারকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। খুচরা বাজারে এখন ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকায়। তবে কিছু সরু চাল ৬৬ থেকে ৬৮ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। নাজির বা কাটারি নাজির নামে বিক্রি হওয়া চালের দাম ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত।
১০ দিনের ব্যবধানে এসব চাল কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মাঝারি আকারে চালের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে। আর মোটা চাল ১-২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। রাজধানীর বাসাবো বাজারের নিউ নুরানী রাইস এজেন্সির মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকেই বাজারে বাড়তি দাম আছে। ফোরকান স্টোরের স্বত্বাধিকার ফোরকান বলেন, পাইকারি বাজারেই আমাদের ভালো মানের মিনিকেট চাল কিনতে হয় ৬৮ থেকে ৭০ টাকা দিয়ে। সেটা ৭০ থেকে ৭২ টাকার কম বিক্রি করা যায় না। অন্য চালের দামও আগের চেয়ে বেশি।
ভরা মওসুমেও চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মিলাররা বলছেন, ধানের মওসুম হলেও বড় বড় মিল মালিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ধান কিনে মজুত করে রেখেছেন। এতে বাজারে সরবরাহ কম হওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে ধানের দাম। তাই চালের দামও বেড়েছে। তাছাড়া বর্তমান আবহাওয়ার কারণে সূর্যের তাপ না থাকায় চাতাল মালিকরা চাল শুকাতে পারছেন না। এজন্যও দাম বাড়তে পারে। বগুড়ার মেসার্স রবিউল অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম বলেন, দেশের বৃহত্তর রাইস মিল মালিকরা আমন ধান বাজারে নামার সঙ্গে সঙ্গে শত শত ট্রাক ধান বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে বাজারে ধানের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও অবৈধ মজুতদাররাও ধান মজুতের মাধ্যমে বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ১২০০ টাকার ধান ১৩৫০ থেকে ১৩৭০ টাকা পর্যন্ত দরে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে বাজারে চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা চাল কল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে চাতাল মালিকরা ধান শুকাতে পারছে না, এর ফলে বাজারে চাল সরবরাহ কম হচ্ছে। এজন্য চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধির পেয়েছে। কুষ্টিয়ার খাজানগরের সুবর্ণ এগ্রো ফুডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরাফাত মামুন বলেন, আমাদের ধান বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, ধানের আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধানের দাম না বাড়লে চালের দামও বাড়তো না। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, ধানের দাম প্রতি মণে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। মণপ্রতি মিনিকেট যে ধান আগে ছিল ১ হাজার ৪২০ টাকা সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬৮০ টাকায়। মিলাররা বেশি দামে ধান কিনছেন তাই চালের দামও বাড়তি।
এদিকে অবৈধ আড়তদারদের উদ্দেশ্যে গতকাল খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, যারা হাজার-হাজার মণ ধান আড়তদারির নাম করে বিনা লাইসেন্সে স্টক করছে, তাদের ছাড় দেয়ার কোনো উপায় নেই। আপনি মিল মালিক হয়েও যদি আপনার কাছে ধান মজুত থাকে তাহলে আপনাকেও ছাড় দেয়ার কোনো উপায় নেই। আমার বাবা হলেও উপায় নেই। খাদ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ধান-চালের বাজার ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ইতিমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য টিম করা হয়েছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, কন্ট্রোল রুম খুলেছি, আমাদের অভিযান চলছে। আজ দেশের ৮টি বিভাগে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এরইমধ্যে অভিযান চলছে। অভিযানে যার কাছে অবৈধ মজুত পাওয়া যাবে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।