ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির জনপ্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি করে একের পর এক মামলায় সাজা দিয়েছিলো আদালত। তড়িঘড়ি করে সাজা দিলেও রায় লেখেননি বিচারকরা। এখন সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের জামিনে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ রায়ের সার্টিফাইড কপি না পেলে জামিনের আবেদন করা যাচ্ছে না। অথচ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের জামিন করাতে দলের আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানিয়েছেন বিএনপি দলীয় আইনজীবীরা।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও দলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচনের আগে নির্ধারিত অফিস সময়ের বাইরে গিয়ে রাতের বেলা আদালতের কার্যক্রম চলেছে। নেতাদের দ্রুত সাজা দিতে এমনটা করেছিলো। কিন্ত দু:খের বিষয় দ্রুত সাজা দিলেও বিচারকরা তখন রায় লেখেননি। এখন দলের আইনজীবীরা রায়ের সার্টিফাইড কপির জন্য আদালতে আবেদন করলে জানানো হচ্ছে রায় লেখা হয়নি। এটা আসলে সরকারের নির্দেশে আদালতের আরেকটি অপচেষ্টা। জামিন নিয়ে নেতারা যাতে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে না পারে সে জন্য এমনটা করা হতে পারে। তবে আমাদের কার্যক্রম চলছে আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে পালিয়ে থাকা নেতাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার।’
সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বিষয়ে দল কি ভাবছে, তারা এখন কি করবে, দলের সিদ্ধান্ত কি জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের আদালতে আত্মসমর্পণ করার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তবে সাজাপ্রাপ্ত নেতারা দলীয় আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পুরনো মামলায় বিএনপি নেতাদের একের পর এক সাজা দেওয়া হয়েছিল। দলটির দপ্তরের তথ্য মতে গত পাঁচ মাসে শতাধিক মামলায় ১ হাজার ৬৮৭ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে রয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাও। কোনো কোনো নেতার একাধিক মামলায় ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ বছর ৮ মাসের সাজা দেয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ কারাগারে রয়েছেন। কেউ কেউ রয়েছেন আত্মগোপনে। আবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রয়েছেন দেশের বাইরে। নির্বাচনের আগে কৌশলী অবস্থানে ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত এসব নেতা। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও এখনো আড়ালে রয়েছেন।
সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনের আগে রাজপথের কর্মসূচিতে এক কিংবা একাধিক দিন অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান জুয়েল, বিএনপির সহ স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসান মিন্টুকে রাজপথের কর্মসূচিতে দেখা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৬ মামলায় ১৭ বছর ৮ মাসের সাজা হয়েছে যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের। বিএনপি’র স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে গত তিন মাসে ৫টি মামলায় ১৫ বছর তিন মাসের সাজা দিয়েছে আদালত।
নির্বাচনের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সরকার ‘ভয়াবহ পরিকল্পনা’ নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমাদের কানে এসেছে যে, প্রায় সাড়ে ১৩ শ মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে, যে মামলাগুলো নির্বাচনের পূর্বেই তারা শুনানি করে সাজা দিয়ে দেবে।’
সংবিধান অনুযায়ী ফৌজদারী মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ কারণেই অংশ নিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সাজাপ্রাপ্ত যেসব নেতার জামিন হয়েছে : ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসে অগ্নিসংযোগ ঘটনায় ভাটারা থানায় মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় গত বছরের ৯ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম শাহজাহান, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৫ জনকে ৪ বছর করে কারাদণ্ড দেয় আদালত। নির্বাচনের আগে তিনিসহ অন্য আসামীরা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে নির্বাচনের আগেই জামিনে ছাড়া পান তিনি। তার সঙ্গে কারাগারে যাওয়া জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাবেক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসান হাবীব লিংকন, বিএনপির সহ প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান, বিএনপি নেতা বেলাল আহমেদ, মনিরুল হক জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
যারা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন : সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, গ্রাম সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, হাবিবুর রশিদ, আকরামুল হাসান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ন ইউনূস মৃধা, মো. মোহন, হাজী মনির, মোশাররফ হোসেন খোকন, রংপুর জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু ও মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব এডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদ প্রমুখ। এ ছাড়া যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।