DMCA.com Protection Status
title="৭

ভারত সরকারের অবস্থান বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের দায় শোধ করতে মরিয়া আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বটাই যেন ভুলে গেছে। তাই তো সীমান্তে বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিন হত্যার প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একজন সদস্য প্রতিবেশী দেশের বাহিনীর হাতে নিহত হলো আর সরকার সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিল। এর অর্থ কী? এ ঘটনার পরে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার কী করল?  বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিনের লাশ ভারতের কাছ থেকে গ্রহণ করে তার পরিবারের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছে। ব্যাস দায়িত্ব শেষ। নিদেন পক্ষে সীমান্তে একটা পতাকা বৈঠক করা এবং কড়া প্রতিবাদ জানানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সেখান থেকে শুধু রইস উদ্দিনের লাশ গ্রহণ করাই যেন ছিল তাদের একমাত্র দায়িত্ব।


শুধু কী তাই! এর কয়েকদিন পর নীলফামারী সীমান্তে আরেক যুবককে গুলিতে হত্যা করা হয়। তারও কোনো প্রতিবাদ হয়নি।


এ দুটি হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণব কুমার ভার্মা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার সচিবালয়ের অফিসে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সে সময় আনন্দে গদগদ ওবায়দুল কাদের তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেন যা কিনা পরবর্তীতে সাংবাদিকদের কাছে বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বড় উৎসাহ নিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে ভারত আমাদের পাশে ছিল একথা স্বীকার করতেই হবে। ওবায়দুল কাদেরের জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ গত ৭ জনুয়ারির নির্বাচন কেবল ভারতের একক প্রচেষ্টায় সরকার পার করতে সক্ষম হয়েছে। এত বড় অবদানকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে। সেজন্য তিনি হয়তো রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উত্থাপন করে আনন্দঘন পরিবেশ নষ্ট হতে দেননি। কিন্তু সাংবাদিকরা এ প্রশ্ন কি উত্থাপন করতে পারেন নাই যে, রাষ্ট্রীয় এক বাহিনীর সদস্যের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি হাইকমিশনারের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে কিনা? আমার দেশের একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বিএসএফের গুলিতে নিহত হলো, সে ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে কিনা- এমন কোনো প্রশ্ন আমরা শুনতে পাইনি। পৃথিবীর কোনো শান্তিপ্রিয় দুই দেশের মধ্যকার সীমান্তে এমন একতরফা হত্যাকাণ্ড দেখা যায় না। বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যা মামলা হতে পারত, কিন্তু হয়নি।


২.


গত বছর ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ চলাকালে পুলিশ যখন কাঁদানে গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালায়, তখন একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। পুলিশের ভাষ্যমতে, আমিরুল ইসলাম পারভেজ নামের একজন সদস্য নিহত হন। কোনো হত্যাকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে বিগত দুই বছরে বিএনপি বহু সভা-সমাবেশ করেছে পুলিশের গুলিতে দলটির ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছে; কিন্তু কোথাও পুলিশের ওপর পাল্টা হামলা করা হয়েছে, এমন নজির নেই। ২৮ অক্টোবর কেন এমন হামলা হলো, সেটা সরকারি দল এক ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু দেশের নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে ২৮ অক্টোবরের হামলা বিএনপির পক্ষ থেকে শুরু হয় নাই। তারা পুলিশের তাড়া খেয়ে যেদিকে পেরেছে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থেকেছে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তারা সেদিন একটি বয়ান বিদেশি মেহমানদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন কিংবা জবাব পাননি। তারা নিরব প্রতিবাদ জানিয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন। তারপরও বলছি, সে ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে। এর বাইরেও সেদিনের ঘটনায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। এসব নেতা কর্মী ঘরছাড়া। বনে-বাদাড়ে, খাল পাড়ে তাদের রাত কেটেছে। নিম্ন আদালতে তাদের জামিন হয় নাই। হাইকোর্ট থেকে এখন তারা জামিন নিচ্ছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীরের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার অভিযোগে পল্টন থানা এবং রমনা মডেল থানায় এগারটি মামলা হয়েছে। দশটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন কিন্তু প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তিনি জামিন পাচ্ছেন না। হাইকোর্টের বিচারপতিরা মনে করেন, মির্জা ফখরুল প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছেন। সেজন্য তাকে জামিন দেওয়া হলো না। অথচ এখনো পর্যন্ত ওই ঘটনার কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলো না। শুধু পুলিশি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই মির্জা আলমগীরের জামিন আটকে দেওয়া হলো-এটাই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা। অবশ্য একই মামলায় বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাজাহান ওমর রাতারাতি জামিন নিয়ে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।





৩.


বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। বিশাল সেই মহাসমাবেশ পণ্ড করে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত বাস্তবায়ন করে। সেদিনের চক্রান্তের পেছনে আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী যে মদত দিয়েছিল সেটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের একটি অংশকে আটক রাখা হলো জেলখানায় , আরেকটি অংশের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি দেওয়া হলো এবং আরেকটি গ্রুপকে দৌড়ের ওপর রাখা হলো। ফলে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিবেশে ঘোষিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না, অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে না, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পরাশক্তি চীন এবং রাশিয়া একটি একতরফা নির্বাচনের পক্ষে সরকারকে উৎসাহিত করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন। সংবিধান লংঘন করা যাবে না বলে সরকার ধনুকভাঙা পণ করলেও ৭ জনুয়ারির পরে সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ থেকে শুরু করে গত ৩০ জানুয়ারি ডামি সংসদের প্রথম অধিবেশন পর্যন্ত সংবিধান লঙ্ঘনের মহোৎসব চলে। আওয়ামী লীগ মানেই এমন একটি সংগঠন, তারা যেটা বলে সেটাই আইন, সেটাই সংবিধান, সেটাই পদ্ধতি। আর অন্য যারা যুক্তির কথা বলে, নৈতিকতার কথা বলে, তারা সবাই সংবিধান লংঘনকারী এবং ষড়যন্ত্রকারী। সিপিডি, টিআইবি এবং নাগরিক সমাজ ইতিমধ্যে কিছু তথ্যভিত্তিক যুক্তি তুলে ধরার কারণে বিএনপির দালালে পরিণত হয়েছে। সিভিকাস ফাউন্ডেশন তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের অবস্থান এখন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তারা এখন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়ে জনকল্যাণে কিছু বলার ক্ষমতা তাদের সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকছে আর বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করে রাখছে।


৪.


আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় জোরপূর্বক থাকতে পারছে, তার অক্সিজেন সরবরাহ করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এর জন্য ভারতের প্রতি সরকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সীমা নেই। যে জন্য বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিন নিহত হলেও তার প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা থাকে না সরকারের। সরকারের মন্ত্রীরা রইস উদ্দিনের এ হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও পারিপার্শ্বিক ঘটনায় মনে হয় এটি ঠান্ডা মাথার একটি খুন। আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে রাখতেই এমন একটি খুন করা হয়েছে বলে ধারণা করা অমূলক নয়। চীনা রাষ্ট্রদূত নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এর সঙ্গে দেখা করে তিস্তা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য চীন সরকারের আগ্রহের কথা পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। তিস্তা প্রজেক্ট নিয়ে যতবার চীন সামনে এগিয়েছে ততবার ভারতে ভেটো দিয়েছে। ভারত যখন তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই সরকার এই তিস্তা প্রজেক্ট নিয়ে চীনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। তিস্তার দুই পাড়ের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে সরকার সেই ২০২০ সালে এই প্রজেক্ট হাতে নেয়। প্রাথমিক হিসেবে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও প্রকল্প শেষ করতে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মঙ্গাপীড়িত নীলফামারী ও লালমনিরহাটের জনগোষ্ঠী সুখের সন্ধান খুঁজে নিতে পারে। এমন উদ্দেশ্য নিয়ে যখন এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সরকার বারবার আগ্রহ দেখাচ্ছে, তখনই ভারতের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।  এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারকে কীভাবে চলতে হবে, তার গাইডলাইন দিয়েছেন মোদি সরকারের অন্যতম থিংকট্যাঙ্ক সাবেক হাইকমিশনার পংকজ সরণ। সেখানে ভারত সরকার যে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে ভোটদানে বিরত রেখে তাদের মনে একটা ক্ষোভ তৈরি করে দিয়েছে, সেটা আমলে নেয়া হয় নাই। বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের চেয়ে ভারতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এক কথায় বলতে হয় বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ভারত সরকার।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!