DMCA.com Protection Status
title="৭

কারাবন্দি বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বজনদের অভিযোগ, নির্যাতন হচ্ছে,চিকিৎসায়ও অবহেলা

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ কারাগারে বন্দি বিএনপি নেতাকর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারা। জামিন না পাওয়া এই নেতাদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরছেন স্বজনের কাছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর তিন মাসে ৯ জন মারা গেছেন। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘অসুস্থতাজনিত’ কারণে মৃত্যু হয়েছে তাদের। অন্যদিকে পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন ও সুচিকিৎসা না পাওয়ায় এই করুণ পরিণতি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ছে অনেক পরিবার। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ। দল থেকে খোঁজখবর নেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কারাবন্দি নেতাদের নিয়েও বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেকের স্বাস্থ্যের অবনতিও ঘটছে। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীও শঙ্কিত। এ পরিস্থিতিতে কারাবন্দি নেতাদের দ্রুত জামিনে মুক্ত করতে কাজ করছেন আইনজীবীরা। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি দৌড়ঝাঁপ করছেন দলের নেতাকর্মীও। তবে বারবার শুনানি হলেও মিলছে না জামিন। স্বজনরা বলছেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হয়, রাজনীতি করাটা যেন অপরাধ

জানা গেছে, গত আগস্ট থেকে সারাদেশে কারাগারে ১২ বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবরের পর মৃত্যু হয় ৯ জনের; যাদের ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের কারও কারও বয়স সত্তরোর্ধ্ব।

বিএনপি নেতাকর্মী আর পরিবারের স্বজনের অভিযোগ, গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হলেও সেখানে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় এসব নেতাকর্মী অকালে মারা গেছেন। এমনকি অসুস্থতার সংবাদও পরিবারকে না জানানো এবং মৃত্যুর পর জানানো হলেও তড়িঘড়ি দাফন করতে অনেক সময়ে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ তাদের।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, দেড় দশক ধরে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং অবৈধ সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গণবিচ্ছিন্ন সরকার আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

তবে কারা উপমহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, সারাদেশের কারাগারে ৭০ হাজারের মতো বন্দি। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব তাদের। সেখানে আন্তরিকতা আর চেষ্টার কোনো ঘাটতি থাকে না। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের চিকিৎসা, প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নেওয়ার সব আয়োজনই দ্রুত করা হয়। এসব বিষয় কেন্দ্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করা হয়।

গত বছরের ২১ আগস্ট কেরানীগঞ্জ কারাগারে মারা যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির একটি ইউনিটের নেতা আবুল বাশার। গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় ওই দিন মহানগর দক্ষিণের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ইদ্রিস আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ আগস্ট কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একটি ইউনিয়নের বিএনপি নেতা সুরাত আলী গাজী মারা যান ১৭ সেপ্টেম্বর।

২৮ অক্টোবরের ঘটনা-পরবর্তী সময়ে কারাগারে মারা যাওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রামের চানগাঁও থানার ওয়ার্ড বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমান। মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৭ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২৫ নভেম্বর তিনি কাশিমপুর কারাগারে মারা যান। মহানগর দক্ষিণের ওয়ারী বিএনপির নেতা ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলকে গ্রেপ্তার করা হয় ২৪ নভেম্বর। কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে ৩০ নভেম্বর তাঁকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।

বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন অভিযোগ করেন, ৩০ নভেম্বর ভোর ৩টা ২০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক বুলবুলকে মৃত ঘোষণা করার পর থেকেই মরদেহের নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ। পরে রাত ৯টায় চুপিসারে দাফন সম্পন্ন করে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে।

গাজীপুরের শ্রীপুর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান খান হীরাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১৮ অক্টোবর। ১ ডিসেম্বর তিনি কাশিমপুর কারাগারে মারা যান। রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার ওয়ার্ড বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয় ৭ নভেম্বর। ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে মারা যান তিনি। নাটোরের সিংড়া ইউনিয়ন যুবদলের নেতা আবুল কালাম আজাদকে ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হলে ৭ ডিসেম্বর হাসপাতালে তিনি মারা যান। নওগাঁর পত্নীতলা ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মতিবুল মণ্ডলকে ২৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। ২০ ডিসেম্বর অসুস্থাবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।

২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা দক্ষিণ শ্রমিক দলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুর রহমান কাজলকে। ২৮ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর পরও তাঁর হাতে হ্যান্ডকাফ আর পায়ে ডান্ডাবেড়ি থাকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।

মেয়ে খাদিজা আক্তার জানান, তাঁর বাবা কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে ২৭ ডিসেম্বর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে অসুস্থতার কথা তাদের জানানো হয়। তারা হাসপাতালে ছুটে গেলেও বাবার সঙ্গে তাদের দেখা করতে ও কথা বলতে দেওয়া হয়নি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে মারা যান তিনি।

খুলনার বটিয়াঘাটা ইউনিয়ন যুবদল নেতা কামাল হোসেন মিজানকে ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২ জানুয়ারি তিনি বাগেরহাট কারাগারে মারা যান। মেয়ের জামাই আরিফ হোসেন জানান, তাঁর শ্বশুর ২ তারিখ মারা গেলেও তাদের জানানো হয়েছে ৩ জানুয়ারি। পরে তড়িঘড়ি লাশ দাফন করতে হয়েছে। যার কারণে কীভাবে তিনি মারা গেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত ২৮ জানুয়ারি সাতক্ষীরা কারাগারে মারা যান বিএনপি নেতা আবদুস সাত্তার খান। বিএনপি নেতাকর্মীর দাবি, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ১৮৪ মামলায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় ২৭ হাজার ৫১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। মারা যান সাংবাদিক, নেতাকর্মীসহ ২৮ জন। একই সময়ে ৯ হাজার ৭০৪ জন আহত হন।

কারাগারে আটক সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়োজ্যেষ্ঠ। অনেকের শরীরেই আগে থেকে রোগ বাসা বেঁধেছে। এর মধ্যে কারাগারের বন্দিজীবনে আরও কাবু হয়ে পড়ছেন ওই সব নেতা। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উচ্চ রক্তচাপ, আইবিএস, মেরুদণ্ড, দাঁতের সমস্যাসহ আরও বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। একইভাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবীব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার ও হাবিবুল ইসলাম হাবিব বয়সের ভারে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কিডনি রোগ ছাড়াও মেরুদণ্ডের গুলির চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন।

সত্তরোর্ধ্ব ওই সব নেতার বাইরেও শারীরিকভাবে অসুস্থ সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অনেক রোগে আক্রান্ত। ৪ নভেম্বর গ্রেপ্তারের আগে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল বলে জানান তাঁর ছেলে সৈয়দ শেহরান এমরান। তিনি জানান, তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁকে ভারতে প্রতি মাসে কেমোথেরাপি দিতে হয়। কিন্তু বাবার অবর্তমানে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ওদিকে বাবার জামিন নিয়েও চলছে নানা টালবাহানা।

প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীর ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছে। এর বাইরেও ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে নিয়মমাফিক চলাফেরা করতে হয়। তাঁর বড় ভাই ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী হ্যাপী জানান, গত ১৪ অক্টোবর এ্যানীকে বাসার দরজা ভেঙে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করে পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকায় যেমন তিনি যে কষ্ট পাচ্ছেন, তার থেকেও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে তাঁর আট বছরের ছোট ছেলে সাবরান চৌধুরীর কান্না। বাবাকে কাছে পেতে প্রতিদিনই কান্নাকাটি করে, বায়না করে; এটা সহ্য করার মতো না।

নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি গত বছরের ২৩ মে থেকে কারাগারে রয়েছেন। হৃদরোগ, লিভার, শ্বাসকষ্টসহ আরও বেশ কিছু রোগে তিনি আক্রান্ত। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১৯৬টি মামলার মধ্যে দুটিতে এরই মধ্যে ছয় বছরের সাজার রায় ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান তাঁর ছোট ভাই এস এম নাইমুল আলম।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!