DMCA.com Protection Status
title="৭

যুদ্ধে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে জান্তা বাহিনী, সীমান্তে বাংলাদেশীসহ দুইজন নিহত

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ চরমে পৌঁছেছে। বিশেষ করে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য আরাকানে সোমবারওব্যাপক গোলাগুলি হয়। বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৬৬ মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ- বিজিপি সদস্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। তাদেরকে নিরস্ত্র করে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি কর্তৃপক্ষ।

এদিকে সীমান্তের ওপারে যুদ্ধের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের বাংলাদেশিদের মধ্যে। সীমান্তের ওপর থেকে গুলি, মর্টারশেল আঘাত হানছে। এতে এলাকাবাসী নিহত হওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

সোমাবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী জলপাইতলী গ্রামে নারীসহ ২ জন নিহত হয়েছেন।

নিহতের একজন হচ্ছেন-আসমা খাতুন (৫৫)। তিনি জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়া সওদারগরের স্ত্রী। অপরজন অজ্ঞাতপরিচয় রোহিঙ্গা এক শ্রমিক। সোমবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, মিয়ানমারের ওপার থেকে ছোড়া মর্টারশেলের বিষ্ফোরিত অংশ জলপায়তলী এলাকায় এসে পড়ে। এ সময় মর্টার শেলের বিষ্ফোরিত অংশের আঘাতে আসমা খাতুন ঘটনাস্থলে মারা যান। গুরুত্বর আহত হন এক রোহিঙ্গা শ্রমিক। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এদিকে এ ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেকেই প্রাণের ভয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে চলে যাচ্ছেন।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে এক বাংলাদেশি নারী ও এক রোহিঙ্গা শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সীমান্তের মিয়ানমার অংশে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে। সীমান্তের বাংলাদেশ অংশের বাসিন্দারা আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীদের ফেরত পাঠাতে দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।

বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি জানান বলেন, “সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যারা আসছে তারা মূলত মিয়ানমারের সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্য। তাদেরকে আমরা কর্ডন করেছি। তাদের নিরস্ত্র করে নিরাপদ স্থানে রেখেছি।"

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ জোরালো করে মিয়ানমারের জান্তা বিরোধী প্লাটফর্ম থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স। তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এর মধ্যেই কোনও কোনও সীমান্ত শহর দখল করে নিয়েছে।

এদিকে আরাকানের যুদ্ধের কারণে নিরাপত্তাহীনতার কারনে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রুতে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া জানিয়েছেন, রবিবার ভোর থেকেই ওপারের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে ওঠে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা গোলার আঘাতে এপারে এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। যে কারণে নিরাপত্তার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, শনিবার গুলির আঘাতে বান্দরবানের একটি সিএনজিতেও গুলি লাগে। তুমব্রুতে একজন আহত হয়েছে এবং বাইশফাঁড়ি সীমান্তের কাছে একজনের বাড়িতে গোলা পড়েছে।

বাংলাদেশে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় গত সপ্তাহে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গোলাগুলি ও মর্টার শেল ছোঁড়ার শব্দ শুনছেন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা।

গত অক্টোবরে আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনী বিরোধী সশস্ত্র জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে ব্যাপক লড়াইয়ে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়। তারা ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দৌরাত্ম্যে চাপে থাকা সেনাবাহিনীর ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু করে।
এরপর গত ১১ সপ্তাহে চীনের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অংশে জোটের হাতে পর্যুদস্ত হয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

এদিকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্বীকার করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি সমাধানে চীনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে সেতু মন্ত্রী বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির সংঘাতে আমাদের কিছু কিছু ক্ষতি তো হচ্ছে। আকাশসীমা লঙ্ঘন হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের চমৎকার সম্পর্ক। এক্ষেত্রে তারা কিছু করতে পারে কিনা বলেছি।”

যদিও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সঙ্কট সমাধানে দৃশ্যত কোনো কাজ করছে না চীন। কেননা সেখানকার এই যুদ্ধ পরিস্থিতির পেছনে চীন-ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন থাকতে পারে।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) রেজাউল করিম বলেন, সরকার ঢাকাস্থ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কথা বলেছেন-এটি জোরালো কোনা পদক্ষেপ নয়। এই মুহূর্তে সীমান্তে বিভিন্ন বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ ও অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতে, মিয়ানমারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে চীনের অবস্থান স্পস্ট নয়। এমনকি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রও কার পক্ষে সেটি প্রকাশ্য হয়নি। এসব এক্ষেত্রে যাদের পাল্লা ভারী থাকে তাদের দিকেই দেশগুলোর সমর্থন থাকবে। এমনটি হলে সঙ্কট বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে করেন না এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

মিয়ানমারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক কূটনীতিক মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল উল্লেখ করে বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন হয়তো মনে করবে এখানে তাদের যে সদস্যরা রয়েছে তাদের ফেরত নিতে চাইবে। আবার আরাকান আর্মির সদস্যরাও যদি পিছু হটে তবে তারাও বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। সব মিলিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়বে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি সামলাতে বর্ডার সীল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!