ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দেশে পাঁচ থেকে ছয় লাখের মত ভারতীয় কর্মী রয়েছেন, যার মধ্যে সাড়ে চার লাখই ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ নিয়ে অবৈধভাবে কাজ করছেন। কয়েক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ভিত্তিক জনপ্রিয় একটি নিউজ চ্যানেলে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অবশেষে সত্য স্বীকার করলো ভারত বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় কাজ করছে’।
দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের এক তরফা নির্বাচনে ভারতীয় সরকারের সরাসরি সমর্থনের পর ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে। পন্য বর্জনের পাশাপাশি অবৈধ ভারতীয় শ্রমিকদেরও দেশে থেকে বের করে দেওয়ার দাবি ক্রমেই জোড়ালো হচ্ছে। এ অবস্থায় খোদ আওয়ামী লীগ সরকার নড়েচড়ে বসেছে । বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিডা) কর্মরত বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় অবৈধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের কঠোর অবস্থা নেওয়া যায় কি না তা নিয়ে ভারতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার কর্মরত অবৈধ বিদেশী কর্মী ও নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নিয়ে এক বৈঠক বিডার সভাকক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন ।
স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিডা অবৈধভাবে কর্মরত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে। এই দুই প্রতিষ্ঠানই অবৈধ ভারতীয় নাগরিকদের দেশে কাজ করতে বাধা দিতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিডা অবৈধ ভারতীয় শ্রমিকদের তালিকা দিলে আমরা এদের বিরুদ্বে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, পাঁচ লাখ ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মরত রয়েছেন তৈরি পোষাক কারখানা ও বায়িং হাউজগুলোতে। এরপর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয়রা কাজ করে। এছাড়াও ট্রাভেল এজেন্সি ও অন্যান্য সেবাখাতেও ভারতীয়রা অবৈধভাবে কাজ করে।
তৈরি পোষাক খাতে প্রায় এক লাখ ভারতীয় টেকনিশিয়ান, ডিজাইনার এবং ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত পদগুলোতে কর্মরত রয়েছেন। এদের অনেকেরই মাসিক আয় দুই হাজার থেকে দশ হাজার ডলার। পোষাক খাতের কারখানা ছাড়াও বায়িং হাউজগুলোতেও প্রায় এক লাখ ভারতীয় কাজ করছেন। এ কারণে দেশের বায়িং হাউজগুলোতে ভারতীয়দের বহুল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশের ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়নের দায়িত্ব প্রাপ্ত উপদেষ্টা এবং বিডার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপ, বেসরকারী বিমান চলাচল মন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভায়ের আজিজ খানের জ্বালানী প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ, অন্যতম বড় পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সদ্য ফরিদপুর থেকে সংদস সদস্য হয়ে আসা এ কে আজাদের হামিম গ্রুপ, নিটল গ্রুপ, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী নাসা গ্রুপে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় কর্মী কাজ করছেন।
এছাড়া আইটি ফার্মগুলোতে সফটওয়্যার এক্সপার্ট হিসেবে এবং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমগুলোতেও ভারতীয় দক্ষ বিশেষজ্ঞদেরকে বিপুল সংখ্যায় কাজে লাগানো হচ্ছে। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এসব কাজের উপযুক্ত দক্ষ পেশাজীবীর বিরাট ঘাটতি রয়েছে।
ভারতীয় নিউজ চ্যানেলের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধ ভারতীয়দের বেতন হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে প্রেরণ করা হয়। বেশির ভাগ ভারতীয় বৈধ-অবৈধ চাকুরিজীবিরা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় তাঁদের আয়ের সিংহভাগ ভারতে পাচার করছেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ শ্রমিকদের বেতন বাবদ পাচার করা অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশী টাকার অংকে প্রায় ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বলে বিডিজবস ডটকমের এক জরিপে বলা হয়েছে। বিডিজবস.কমের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, তৈরি পোষাক শিল্প ও আইটি ফার্মের এক শ্রেণীর বাংলাদেশী মালিক তাঁদের নানাবিধ অবৈধ কাণ্ড গোপনে ও নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য ভারতীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়াকে বেশি নিরাপদ বলে মনে করে থাকেন।
এদিকে সরকারের হিসাব অনুসারে দেশে বর্তমানে বিশ্বের ১১৫টি দেশের ২০,৯৮৮ জন বিদেশি নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি চীনের নাগরিক। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কয়েক মাস আগে জাতীয় সংসদে এ তথ্য জানান।
বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা শিল্পকারখানা, উন্নয়ন প্রকল্প, এনজিও, আইএনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭৫ জন চীনা, ৫ হাজার ৮৭৬ জন ভারতীয়, ২ হাজার ৪৬৮ জন রুশ, ১ হাজার ২৪৬ জন শ্রীলঙ্কান, ৯২৪ জন দক্ষিণ কোরিয়ান, ৫৫৭ জন জাপানি, ৪১৬ জন পাকিস্তানি, ৪৬০ জন ফিলিপিনো, ৩৯৯ জন থাই, ৩৭৮ জন বেলারুশিয়ান, ২৬৯ জন কাজাখ, ১৬৮ জন আমেরিকান, ১৩৯ জন কোরিয়ান, ১২৩ জন মালয়েশিয়ান, ১০৮ জন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক রয়েছেন।