ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বুয়েটে আবরার ফাহাদের হত্যার পর সবাই ভেবেছিলো ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবার একটু হলেও থামবে। তবে না, ছাত্রলীগের কর্মকান্ড থামার বদলে এখনো চলছে আগের মতোই। কিন্তু এসব নিয়ে কথিত সুশীল সমাজের কোনো আপত্তি নেই। তাদের এই কর্মকান্ডের বিপরীতে কোনো শাস্তি নেই, আদতে এই সরকারের আমলে তাদের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। আওয়ামীলীগের এই শাসনামলে ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে এমন ঘটনা খুবই কম, হাতে গোনা কয়েকটা। অথচ কথিত নাশকতা মামলায় দিনের পর দিন জেল খাটছেন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা।
সম্প্রতি জাবি ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণের ঘটনায় আবারো আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগের এসব অনৈতিক কর্মকান্ড। সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর বহিরাগত বন্ধু মামুনুর রশিদের সহযোগিতায় এক দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রাখেন। পরে মোস্তাফিজুর ও মামুন মিলে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। প্রাথমিকভাবে পুলিশ দোষীদের আটক করলেও কতটুকু উপযুক্ত শাস্তি তারা পাবে তা নিয়ে সংশয় আছেই। কারণ তারা ছাত্রলীগের নেতা। সামান্য সমাবেশ করার দায়ে পুলিশ নেতাকর্মীদের আটক করে রাখে দিনের পর দিন, আটককৃত অবস্থায় এই কারাগারেই প্রাণ যায় অনেকের। আর ছাত্রলীগের এই অমানবিক কর্মকান্ডগুলোর পরেও উপর্যুক্ত কোনো শাস্তি নেই। এই মন্তব্য লেখার একটু আগের খবর; সংঘর্ষের ছবি তোলায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে দুজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। দুদিন আগে কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চরে মিলন হোসেন (২৭) নামে এক যুবকের ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এস কে সজীব স্থানীয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের পরেও তিনি স্বাভাবিকভাবে শহরে ঘোরাফেরা করছিলেন। কারণ তিনি জানেন, তিনি সরকারী দলের লোক। তার কোনো বিচার এদেশে নাই।
সেদিন কালবেলায় প্রকাশিত ছাত্রলীগ সম্পর্কিত দুইটা খবরে আবার চোখ পড়লো আমার। একটা প্রতিবেদনে দেখলাম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীরা অফিসে ঢুকে এক কর্মকর্তাকে হেনস্তা ও হত্যার হুমকি দিয়েছে। এই ঘটনারও একদিন আগের এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা মিললো বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রী সাইমুনের সব অপকর্মের চিত্র। হলে জুনিয়রদের রুমে ঢুকে রীতিমত হুমকি দেন, সভা-সমাবেশে যাওয়ার জন্য বাধ্য করেন। আরও কত কি!
২০১৯ সালের অক্টোবরে যুগান্তরে প্রকাশিত হওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে শেষ ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। ২০১৯ সালের পর তাদের অপকর্মের হার বেড়েছে আরও কয়েকগুণ।
তাদের অপকর্ম নিয়ে পুরোপুরি লিখতে গেলে দিন ফুরাবে না আমার। এই পনেরো বছরের আওয়ামী শাসনে দিনের পর দিন জেল খাটতে দেখেছি আমার আশপাশের নিরপরাধ মানুষগুলোকে। হাইস্কুলে যখন পড়তাম দেখতাম এলাকার কয়েকজন মিলে কোর্টে যাচ্ছেন মামলার হাজিরা দিতে। এই মামলাগুলো নিয়ে এখনো তারা দৌড়ের ওপর আছেন। নির্বাচন আসলেই শুরু হয় ধরপাকড়, এই ধরপাকড় এড়াতে দিনের পর দিন থাকেন আত্মগোপনে। তবুও তারা শাহজাহান ওমরদের মতো হাল ছাড়েন না, বুকে আশা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার।
ছাত্রলীগের তাণ্ডবে দেশে যখন এই অবস্থা তখন তরুণেরা ভয় পায় এসব অপকর্ম কিংবা সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলতে। সরকারের নতুন নতুন আইন শুধু সাধারণ জনগনের বাকস্বাধীনতা দমনের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা। ছেলের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে মাকে দিনের পর দিন কারাভোগ করতে হয়। সরকারের সমালোচনা করলে খাদিজার মতো শিক্ষার্থীকে বিনা অপরাধে মাসের পর মাস জেল খাটতে হয়। সাংবাদিকরা সরকারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করলে তাদের না পেয়ে তাদের মা-বোনের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। আরও কত কী!
সামান্য কয়েক কোটি টাকার মিথ্যা মামলা নিয়ে এখনো কারাবাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আবার এই দেশেই এস আলমের কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটের বিচার হয়না। কিংবা সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়না, কিংবা হবেওনা। আইনমন্ত্রী হাটতে বসতে যে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বুলি শুনান সেই বিচার ব্যবস্থায় এক রাতে শাহজাহান ওমর জেল থেকে বের হয়ে নির্বাচন করেন। আর একই মামলায় আটক হওয়া মির্জা ফখরুল এখনো জেলে। এই হলো স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার নমুনা। এই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় সবারই বিচার হয়, শুধু বিচার হয়না প্রধানমন্ত্রীর লোকদের।
জনগণের এখন এটুকুই আশা, দেশে গণতন্ত্র ফিরুক, বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হোক, লুটেরাদের শাস্তি হোক। পাশাপাশি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অলিখিতভাবে ধর্ষণ, হত্যার ‘লাইসেন্স’ দিয়ে রাখা এই সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনের ইতি ঘটুক।
আব্দুল ওয়াহিদ তালিম লন্ডন প্রবাসী ফ্রিল্যান্স সংবাদকর্মী এবং মানবাধিকারকর্মী
ইমেইল: [email protected]