ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন বিভাগের একজন ছাত্রী। গতকাল শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ওই শিক্ষার্থী। অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে শিক্ষকের সঙ্গে তার কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ রেকর্ড এবং বার্তা আদান-প্রদানের স্ক্রিনশটও দেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত আক্রোশে একটি ব্যাচের ফলাফলে ধস নামানোর অভিযোগও আছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমান অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘একজন মেয়ে আজকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। আগামীকাল এটি উপাচার্যের কাছে সাবমিট করা হবে।’
অভিযোগপত্রে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রতি ক্লাসেই তিনি (শিক্ষক নাদির জুনাইদ) অ্যাসাইনমেন্টের টপিক নির্ধারণ করতে বলতেন এবং টপিক অনুমোদনের জন্য তাকে সরাসরি ফোন দিতে বলতেন। এই সুবাদে আমি টপিক নির্ধারণের জন্য ফোন দিলে তিনি রাতে কল ব্যাক করতেন এবং ন্যূনতম এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেছেন। এ সময় তিনি টপিকের বাইরে গিয়েও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ সহকারে কথা বলেছেন। তিনি সব সময় জিজ্ঞেস করতেন তাকে আমার কেমন লাগে ইত্যাদি। একপর্যায়ে তিনি তার বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন এবং স্পষ্টভাবে আমার দিকে ইঙ্গিত করেন। আমি খুব অবাক হই এবং খুব অস্বস্তিতে পড়ি। তবে, আমি কৌশলে তাকে নাকচ করে দিই। এরপর তিনি আমাকে নিজে থেকে বলেন, “আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে”। এ ছাড়া তিনি আমার শারীরিক অবয়ব সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করতেন এবং যৌন উত্তেজনা প্রকাশ করতেন।’
অভিযোগপত্রে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘তিনি (শিক্ষক নাদির জুনাইদ) আমার সঙ্গে এমন কথাবার্তা বলতেন, যার বেশিরভাগ কথাই সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে। এ ধরনের কথাগুলো ছিল আমার জন্য তীব্র যন্ত্রণার। আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি, কত দিন এই অস্বস্তি এবং মানসিক কষ্ট নিয়ে রাত-দিন পার করেছি কেউ জানে না। তিনি সাধারণত ১০-১১টার মধ্যে কল দিতেন। কিন্তু যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুরু করলে গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলতে চাইতেন।’
শিক্ষক নাদির জুনাইদ তার জন্মদিনে অভিযোগকারী শিক্ষার্থীকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যান উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তার জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে দাওয়াত দেন। তিনি আমাকে বারবার বাসায় যাওয়ার জন্য বলতে থাকেন। আমি বলি, আপনার পরিবার অবগত আছে কি না। তিনি নিশ্চিত করলে জন্মদিনে তার বাসায় যাই। তার বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করি। একপর্যায়ে তিনি ছাদে নিয়ে যান। এ সময় সিঁড়ির কাছে তিনি আমার উচ্চতা পরিমাপের কথা বলে কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেন। আমি বিগত দেড় বছর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এ যন্ত্রণার প্রকাশ আমি তার সামনে করতে পারিনি। একপর্যায়ে এ যন্ত্রণার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। গত বছরের শুরুতে আমি কাউন্সিলিংও করি। ঘুমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ খেতে হতো। তিনি আমাদের বিভাগের সামনে চেয়ারপারসন হচ্ছেন। শুধু এই ভয়ে আমার পরিবারের কাছে দেড় বছর আগে থেকে বলতে হচ্ছে যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করব না। দরকার হলে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব।’
অভিযোগপত্রে ওই শিক্ষার্থী সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে নাদির জুনাইদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
এর আগে গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে একই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ‘ব্যক্তিগত আক্রোশে’ নম্বর কম দেওয়ার লিখিত অভিযোগ দেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারে তার (নাদির জুনাইদ) দুটি অপশনাল’ কোর্স থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী কোর্স দুটি নিয়ে আগ্রহী হননি। এই ক্ষোভ থেকেই এমন করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন তারা। কোর্সটির ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই কোর্সটিতে ৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জনই চার পয়েন্টের স্কেলে ৩-এর নিচে পেয়েছেন। এর মধ্যে ২.৫০ পেয়েছেন ১৪, ২.২৫ পেয়েছেন ১২ ও ২.০০ পেয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে স্নাতকপর্যায়ে ফলাফলে প্রথম দশজনের মধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া ছয়জনের মধ্যে একজনই ২.৭৫ পেয়েছেন। অন্যরা ২.২৫-এর নিচে পেয়েছেন। এ ধরনের ফলাফলকে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ভাইভায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভাইভায় অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে পরীক্ষার্থীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলতেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো শিক্ষকের নম্বর কম দেওয়ার সুযোগ নেই। পরীক্ষার নম্বর একজন শিক্ষক দেন না। কেউ কমবেশি দিলে সেটা আবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। আর ভাইভায়ও তো একজন শিক্ষক থাকেন না, সবার নম্বর গড় হয়। এখানে শুধু আমাকে কেন টার্গেট করা হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, আমার কোর্স না নেওয়ায় ক্ষোভ দেখিয়েছে। অথচ আমিই শিক্ষার্থীদের বলি এই কোর্স বেশি কঠিন, তোমরা নিয়ো না। কয়েক বছর ধরেই কেউ নেয়নি, আমি তো রাগ করিনি। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণে কষ্ট পাচ্ছি। তাদের রেজাল্ট নিয়ে আপত্তি থাকলে আমার কাছে আসতে পারত, সেটি না করে গণমাধ্যমে আমাকে ভিন্নভাবে তোলা হচ্ছে। আমার সম্মানহানি হচ্ছে।’ তবে যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি। এ ধরনের কাজ হয়ে থাকলে তা খুবই দুঃখজনক। কোনো শিক্ষক এমনটা করতে পারেন না। উপাচার্য মহোদয় বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’