ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গ্রামে কাজকর্মের সংকট। সংসার চলে টেনেটুনে। পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনতে ভিন্ন কিছু করার কথা ভাবছিলেন মেহেরপুরের গাংনীর একদল যুবক। এরই মধ্যে উপজেলার কয়েক দালালের কাছ থেকে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব পান। সহজ-সরল এই দিনমজুরদের স্বপ্ন দেখিয়ে বলা হয়, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গেলে ভাগ্য খুলে যাবে; আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে কেউ শেষ সম্বল, কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করেন, আবার কয়েকজন উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা জোগাড় করেন। কষ্টার্জিত সেই অর্থ দালালদের হাতে দিয়ে পাড়ি জমান সুদূর প্রবাসে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তারা এমন বিপদে পড়েছেন, এখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা! প্রতিনিয়ত ফোন করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি গাংনী থেকে মালয়েশিয়া যান ৬০ জন। তাদের মধ্যে উপজেলার কাজিপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের ছেলে শাহীন আলম, কাবেরের ছেলে রাজন আলী, মুরাদের ছেলে অলিল, আনারুলের ছেলে রেজাউল নিজ নিজ পরিবারের কাছে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। এতে তারা বলেছেন, বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তাদের প্রবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো কাজে নিয়োগ করা হয়নি। গ্রামের যেসব দালাল তাদের মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে, তারা যেন দ্রুত কথা বলে কাজের ব্যবস্থা করে। অন্যথায় জীবিত যেন গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের কেএনএসএইচ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক মাজেদ মাস্টার, কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে ন্যাড়া, বালিয়াঘাট গ্রামের আনিসুল হক মাস্টারের ছেলে শোভন, সাহেবনগর গ্রামের সুরুজ, তার ভাই আওয়াল ও মুসা কলিম ভালো কাজের কথা বলে টাকা নিয়েছে। তারা রাজধানীর নাভিরা ও মুসাকলিম এন্টারপ্রাইজ এজেন্সির মাধ্যমে আমাদের মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। কিন্তু এখানে আসার পর কোনো কাজই দেওয়া হয়নি। উল্টো একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। প্রথম দিকে খাবার ও পানি দেওয়া হতো। কয়েক দিন আগে সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। খাবার চাইলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দেশ থেকে আর্থিক সহায়তা এনে কোনোরকমে বেঁচে আছি। আমাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ায় পালিয়েও যেতে পারছি না। যে ঘরে রাখা হয়েছে, সেখানকার বিদ্যুৎ সংযোগও কয়েক দিন আগে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
কাজিপুর গ্রামের প্রবাসী জহিরুলের বাবা ইসরাফিল আলম বলেন, বড় আশা নিয়ে ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে আমরা পথে বসেছি। ছেলের মানবেতর জীবনযাপন ও আহাজারিতে দেশে আমাদের পরিবারে শোকের মাতম চলছে। সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে জমি বন্ধক রেখে, ঋণ করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে সর্বশান্ত হয়েছি। পাওনাদাররা বারবার বাড়িতে এসে টাকার জন্য পিড়াপিড়ি করছে। ওদিকে ছেলের বাঁচার আকুতি। দালালরাও গা ঢাকা দিয়েছে।
প্রবাসী রাশিদুলের স্ত্রী সাথীয়ারা খাতুন বলেন, সামান্য জমি ছিল, তা বিক্রি করেছি। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ও এনজিও থেকে ঋণ করে স্বামীকে বিদেশ পাঠিয়েছি। সেখানে স্বামীকে কাজ না দিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। খাবার-পানি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। এখন টাকা না পাঠালে কিছু খেতে পারে না। আমরা সহায় সম্বলহীন। কীভাবে টাকা পাঠাব? তার ওপর পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমরা এখন দিশেহারা। এ অবস্থায় সরকারের সহায়তা কামনা করছি।
কাজিপুর ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন জানান, দেশে ছেলেগুলো কাজকর্ম করে কোনো রকমে চলছিল। ভাগ্য ফেরাতে বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। চোখের নামনে পরিবারগুলোর কষ্ট, খুবই বেদনাদায়ক। বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করছি।
প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে জানতে দালালদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘরে তালা দিয়ে তারা নিরুদ্দেশ হয়েছে। বন্ধ রেখেছে নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরও।
গাংনী থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, দালালদের খোঁজখবর নেওয়া ও অসহায় পরিবারগুলোকে আইনগত সহযোগিতা করা হবে। তাদের লিখিত আবেদন করতে বলা হয়েছে। পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক জানান, এ ঘটনায় এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে।
জেলা প্রশাসক শামীম হাসান বলেন, বিষয়টি শোনার পর তাৎক্ষণিক ভুক্তভোগীর বাড়িতে ছুটে যাই। তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছি। তাদের বলেছি, দালালদের টাকা দেওয়ার কোনো কাগজপত্র বা প্রমাণ থাকলে সেগুলো নিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে প্রতারকদের খুঁজে বের করে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।