ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভিজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অন্তত ১০ লাখ ভারতীয়। এর মধ্যে অন্তত ২ লাখ ভারতীয় নাগরিক নিয়মিত আসা-যাওয়া করে গার্মেন্ট, চামড়া শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি খাত এবং নির্মাণ শিল্পের উচ্চপদে কাজ করছেন। এদের সিংহভাগই বিজনেস ভিসা (বি-ভিসা), ট্যুরিস্ট ভিসা (টি-ভিসা) নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এদের অধিকাংশেরই ওয়ার্ক পারমিট বা কাজ করার অনুমোদন (এ-থ্রি ভিসা) নেই। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বছরে মাত্র ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আছে; তাই ট্যুরিস্ট ভিসা, বিজনেস ভিসায় এসেই বছরের পর বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বা হিসেব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে বছরে অন্তত ৩৪ হাজার কোটি টাকা গার্মেন্ট, চামড়া শিল্প থেকে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কানরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮০ সালের দিকে তামিল বিদ্রোহ বাঁধলে শ্রীলঙ্কার বদলে তৈরী পোশাক শিল্প বাংলাদেশে বিস্তৃত হতে থাকে। এসময় দক্ষ শ্রমিক এবং কর্মী হিসেবে শ্রীলঙ্কা থেকে বিপুল সংখ্যক জনবল আসে বাংলাদেশে। অন্তত এক দশকেরও বেশি সময় শ্রীলঙ্কানদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশীয় এই শিল্পে ৯০’এর দশকে ভারতীয়দের আবির্ভাব হয়। পর্যায়ক্রমে তৈরী পোশাক শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয়- বিশেষ করে রাজস্থান, জম্মু, কাশ্মীর, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কর্মী আসতে থাকে।
২০০০ সালের মধ্যেই তৈরী পোশাক শিল্পের ইআরপি (এন্টারপ্রাইস রিসোর্স প্ল্যনিং) সম্পূর্ণ ভারতীয় সফটওয়ার কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে তৈরী পোশাক শিল্পের যে কোনো কারখানার পরিচালনা, উৎপাদন, আয়-ব্যায়, ক্রেতার কাজের আদেশ, শ্রমিক ম্যনেজমেন্টের কর্তৃত্বে থাকছে ভারতীয় কর্মীরাই। যা চলছে প্রায় ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে।
শ্রীলঙ্কানরা এখন শুধু তৈরী পোশাক শিল্পের প্রকৌশল বা ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরের বড় পদ গুলোতে থাকলেও ভারতীয়দের হাতে চলে গেছে কারখানার উৎপাদন, বিপনন, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনাসহ সবগুলো ক্ষেত্র। বাংলদেশীরা শুধু সামান্য কর্মী বা শ্রমিক পর্যায়েই কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। এই শিল্পের অধিকাংশ আয়ই চলে যাচ্ছে ভারত, চীন এবং শ্রীলঙ্কায়। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ভারতীয় কর্মীদের। আবার এদের প্রায় সবাই অবৈধ ভাবে কাজ করছেন বাংলাদেশে।
অবৈধ বিদেশী এই কর্মীরা মজুরি বা বেতন নিতেও ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। বেতনের ৮০ শতাংশ তারা ক্যাশ পেমেন্টে নেন। এই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে তারা নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন। বাকি ২০ শতাংশ নেন ব্যাংকিং চ্যনেলে, তাও আবার বহুজাতিক ব্যাংকের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশ সরকার টেরই পায় না কীভাবে চলে যাচ্ছে দেশের টাকা।
বাংলাদেশের একটি বৃহৎ তৈরী পোশাক কারখানার প্রধান মার্চেন্ডাইজার পদে ১০ বছর ধরে কাজ করা আসাদুজ্জামান এ তথ্য জানান। বর্তমানে তিনি নিজেই একটি কারখানা চালাচ্ছেন।
তৈরী পোশাক শিল্পের উচ্চ থেকে মধ্যম পর্যায়ের ৬০ শতাংশ এখন ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং চায়নাদের দখলে। এই ৬০ শতাংশের মধ্যে ৮০ শতাংশই আবার ভারতীয় কর্মী বা কর্মকর্তা বলেও জানান তিনি।
তৈরী পোশাক খাত, চামড়া শিল্প এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে কত বিদেশী কর্মী আছেন এর সঠিক হিসেব নেই কারো কাছেই।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সরকার। সেই হিসেব মতে, দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭। এদের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ভিসায় ১০ হাজার ৪৮৫ জন, এমপ্লয়ি ১৪ হাজার ৩৯৯, শিক্ষার্থী ৬ হাজার ৮২৭ ও ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন।
সরকারের হিসেবেই সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক- ৩৭ হাজার ৪’শ ৬৪ জন। আর চীনের নাগরিক রয়েছেন ১১ হাজার ৪শ ৪ জন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি) হিসেবে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ। এদের মধ্যে অধিকাংশই পর্যটন ভিসা নিয়ে দেশে এসে অনুমতি না নিয়েই অবৈধভাবে কাজ করছে। এদের অর্ধেকের বেশি ভারতীয় নাগরিক। তাদের হাত ধরে দেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত আড়াই লাখ বিদেশি বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।
কর অঞ্চল-১১ এ কর দেয়া বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৫’শ জন। বাকিদের আয়ের কোনো হিসাব নেই সরকারের হাতে। যে ৯ হাজার ৫’শ জন কর দিচ্ছে তাদের আয়েরও সঠিক তথ্য গোপন করেছে বলে টিআইবি জানিয়েছে।
এর বাইরেও অন্তত দেড় লাখ ভারতীয় নাগরিক ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে তৈরী পোশাক, চামড়া শিল্প ও নির্মাণ শিল্পে কর্মরত রয়েছেন। ট্যনারি শিল্পে এ্যপেক্স ও বে এই দুই কারখানার উচ্চপদস্থ অধিকাংশ কর্মীই ভারতীয়।
বসুন্ধরা গ্রুপে কর্মরতদের একটি বড় অংশ ভারতীয়। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাক্তিগত স্টাফদের বৃহৎ অংশই ভারতীয় নাগরিক।
বেক্সিমকো গ্রুপের বেশ কয়েকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানেও বহু ভারতীয় কর্মী রয়েছে। বিশেষ করে বেক্সিমকো এলপিজি, টেক্সটাইল, নিটেক্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসে আছে ভারতীয় নাগরিকরা। এদের অধিকাংশই ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বছরের পর বছর চাকরি করছেন।
হামিম গ্রুপের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতেও বহু ভারতীয় কর্মী রয়েছেন। বিশেষ করে গার্মেন্টের ম্যানেজমেন্ট লেভেল সামলাচ্ছেন ভারতীয় নাগরিকরা। এ তথ্য হা-মীম গ্রুপ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বহু দক্ষ এবং বিশ্বমানের কর্মী রয়েছে। কিন্তু শুধু ইআরপি (এন্টারপ্রাইস রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়ারটি ভারতীয়দের দখলে থাকায় উচ্চপদে কর্মী খোঁজার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সাথে সাথেই ভারতীয় নাগরিকরা সিন্ডিকেট করে তাদের লোক নিয়ে আসে।
তরুণ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান জানান, গার্মেন্টে উচ্চপদে কর্মী খোঁজা হয় মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংকড-ইন’এর মাধ্যমে। একটি কারখানায় উচ্চপদে একজন যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই তিনি উচ্চপদে নিয়োগের জন্য ভারতীয় নাগরিকদের প্রাধান্য দেন। আর নিয়োগ নিশ্চিতের পর ট্যুরিস্ট বা ভিজিট ভিসায় চলে আসেন ভারতীয় নাগরিকরা। আর বছরের পর বছর কোনো প্রকার ট্যক্স ছাড়াই চাকরি করছেন এরা। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে হাজার কোটির বেশি টাকা।
আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থান করে কাজ করলে আয়কর প্রদান ও কাজের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এ-থ্রি ভিসায় বহু বিদেশী বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করলেও ২০০৬ সালে প্রণীত ভিসা নীতিমালায় কাজের অনুমতি গ্রহণের শর্ত না থাকায় এ-থ্রি ভিসাধারীরা কাজের অনুমতি নেন না। এতে তাদের জন্য আয়কর ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়।
কাজের অনুমতিবিহীন বিদেশীরা দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন। পুরনো পাসপোর্টের স্থলে নিজ নিজ দেশের ঢাকাস্থ দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছাড়তে পারছেন এবং পুনরায় আসার সুযোগ পাচ্ছেন। কালো তালিকাভুক্ত বিদেশীরাও নতুন পাসপোর্ট ব্যবহার করে নতুনভাবে ভিসা নিয়ে প্রবেশ করছেন। অনুমতি ছাড়া অবস্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করে বিদেশীদের ভিসার শ্রণী পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন।
বিডা, ইমিগ্রেশন এবং টিআইবির কাছে যে তথ্য আছে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন বেপজা’র কাছে সেই তথ্যও নেই। বেপজা সূত্র বাংলা আউটলুককে জানায়, তাদের কাছে ৯টি ইপিজেড এর গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানায় মোট ১ হাজার ৮শ ৩০ জন বিদেশী কর্মী রয়েছে।
এর মধ্যে ৮’শ ৭৫ জন তাইওয়ান, হংকং ও চীনা নাগরিক। এদের মধ্যে টেকনিশিয়ানই বেশি। ১’শ ৮৩ জন ভারতীয় নাগরিক রয়েছেন। এদের সবাই কারখানাগুলোর উচ্চপদস্থ সিইও, সিওও, সিএফও, জিএম পদের কর্মকর্তা। আর শ্রীলঙ্কান নাগরিক রয়েছেন ৪’শ ৭০ জন। এরা মূলত কারখানাগুলোর ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে কর্মরত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (আরএমএমআরইউআই)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. সি আর আবরার বাংলা আউটলুককে বলেন, এই বিষয়টি আমলে নিয়ে এখন কাজ করা জরুরি। আমাদের দেশের কেউ কোনো দেশে অবস্থান করলে সেই দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে হিসেব থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই হিসেব নেই; এটি খুবই অগ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, বিদেশী শ্রমিক বা কর্মী আসা কোনো দোষের কিছু না। কিন্তু তারা কীভাবে পারিশ্রমিক নিচ্ছে, কীভাবে সেই টাকা তাদের দেশে যাচ্ছে এর একটা সঠিক হিসেব থাকা জরুরি। এই হিসেব না থাকলে বাংলাদেশ থেকে কী পরিমান রেমিটেন্স বিদেশীরা নিচ্ছে তারও হিসেব থাকছে না বলে জানান সি আর আবরার। আর ভিজিট ভিসায় এসে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া যদি কেউ কাজ করেন, সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি মনে করনে, বিদেশী কর্মীদের কেন আনা হচ্ছে, কোন কোন সেক্টরের জন্য আনা হচ্ছে, সেই সকল সেক্টরে আমাদের দক্ষ জনবল আছে কি না তাও ভেবে দেখতে হবে। না থাকলে জনবল তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার জন্য হলেও এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাজ করা জরুরি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।