ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ যেকোনও একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনও একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন বা জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। জিআই স্বীকৃতি ওই সামগ্রীর নির্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে। কোনও পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সাবেক ‘পেটেন্ট অফিস’ এবং ‘ট্রেডমার্কস রেজিস্ট্রি অফিস’ দুটি একীভূত করে ২০০৩ সালে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর হিসাবে কার্যক্রম শুরু করে। এই অধিদফতরের মূল কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে মেধাসম্পদ সুরক্ষায় নতুন নতুন উদ্ভাবনের পেটেন্ট, ডিজাইন স্বত্ব মঞ্জুর করা, পণ্য ও সেবার ট্রেডমার্ক ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) নিবন্ধন করা।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা ২৮টি। সবশেষ সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আরও চারটি পণ্যকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়ে জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। পণ্য চারটি হলো- রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজারের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর ও মুক্তাগাছার মন্ডা। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে জিআই পণ্য হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা এবং নরসিংদীর অমৃত সাগরকলার জিআই সনদের জার্নাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন।
জানা গেছে, দেশে প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি শাড়ি, ২০১৬ সালে। এরপর বাংলাদেশের ইলিশ মাছসহ আরও অনেক পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে। আর সবশেষ চারটি পণ্যের জিআই স্বত্বের ঘোষণা দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করেছে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি)। এর মধ্য দিয়ে দেশে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ২৮টিতে। এছাড়া জিআই সনদের জন্য ডিপিডিটিতে আবেদন জমা রয়েছে আরও কয়েকটি পণ্যের। মসলিনের পর বাংলাদেশের জামদানি ইতোমধ্যে বৈশ্বিক ক্রেতাদের নজর কেড়েছে।
পণ্যের জিআই সনদ পাওয়ায় সুবিধা কি? এ প্রসঙ্গে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান জানিয়েছেন, জিআই সনদ উৎপাদকদের পণ্যের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়। এতে অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে তাদের পণ্য আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে তাদের এই পণ্যের আলাদা খ্যাতি তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপদনকারীরা পণ্যের জন্য ভালো দাম পান। ট্রেডমার্কের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো ট্রেডমার্ক কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিতে পারেন কিন্তু জিআই সনদ একটি দেশ প্যাটেন্ট করতে পারে। যা সেই দেশের পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে পরিচিতি পায়। এতে স্থানীয় উৎপাদকরা ভালো দাম পাবেন। মোট কথা জিআই পণ্য কোনও দেশ আমদানি করতে চাইলে তাহলে উৎপাদনকারী দেশকে একটি নির্ধারিত হারে রয়েলটি পরিশোধ করতে হবে। যা জিআই সনদ না পাওয়া পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়াও জিআই পণ্য প্রক্রিয়ায় একটি দেশ তার দেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যকে নিবন্ধন করে। এর ফলে ওই পণ্যটি যেমন ব্র্যান্ডিং পায়, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে সেই পণ্যের মূল্যও বাড়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কিছু পণ্যের জিআই স্বত্ব নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিমতের হতে পারে। এসব পণ্যের মধ্যে অন্যতম সুন্দরবনের মধু। সুন্দরবনের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে অবস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশেও ডিপিডিটিতে সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বত্ব নিয়ে আবেদন করা রয়েছে। জিআই সনদ পাওয়ার জন্য ডিপিডিটিতে যেসব পণ্যের আবেদন জমা পড়েছে সেগুলো হলো— যশোরের খেজুর গুড়, নরসিংদীর লটকন, জামালপুরের নকশিকাঁথা, মধুপুরের আনারস, সুন্দরবনের মধু, রাজশাহীর মিষ্টিপান, শেরপুরের ছানার পায়েশ, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ এবং নওগাঁর নাগ ফজলি আম। ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে এসব আবেদনের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া দিনাজপুরের লিচু রয়েছে আবেদনের প্রক্রিয়ায়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের যে সব পণ্য জিআই সনদ পাওয়ার তালিকায় রয়েছে সেগুলোর কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের জিআই পণ্যগুলো
নিবন্ধিত জিআই পণ্য বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি। জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পায় জামদানি। এটির আবেদনকারী ও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন। জামদানি নিবন্ধিত হয় ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। আর জিআই সনদ পায় ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ। এটির আবেদনকারী ও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো মৎস্য অধিদফতর। ইলিশ নিবন্ধিত হয় ১৩ নভেম্বর ২০১৬ সালে। ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম জিআই সনদ পায়। এটির আবেদনকারী ও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এটি নিবন্ধিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল আর সনদ পায় ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন, ২০২১ সালে রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল, নেত্রকোনার সাদামাটিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর একে একে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা চাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা ও টাঙ্গাইল শাড়ি, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজারের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর ও মুক্তাগাছার মন্ডা। এসব এখন থেকে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে জিআই স্বত্বের প্রক্রিয়াধীন আবেদনগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভায় নির্দেশনা জারি করে বলা হয়— মধুপুরের আনারস, নরসিংদীর লটকন, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধের দই ইত্যাদিসহ জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য যেসব আবেদন অনিষ্পন্ন আছে, তা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে এক বা একাধিক পণ্য বা বস্তু খুঁজে বের করে আবেদন করার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করা হয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির পর এগুলোকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, আমাদের সব জেলা-প্রশাসকদের বলা হয়েছিল স্থানীয় পণ্যগুলোর জিআই সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে আবেদন দেওয়ার জন্য। এর অনেকগুলো এরই মধ্যে চলে এসেছে। এগুলো নিয়ে দ্রুতই বসে নিষ্পত্তি করা হবে। জিআই স্বত্ব সনদ প্রাপ্তির আবেদন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যারা আবেদন করেন তাদের যথাযথভাবে ডকুমেন্টেশনগুলো সম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকের ঘাটতি থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যারা উৎপাদনকারী বা যে এলাকায় যে পণ্য উৎপাদন হয় সেখানকার সংশ্লিষ্ট অনেকেই এসব ডকুমেন্টেশনের নিয়মগুলো জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা আসার পর আমাদেরকে তাদের এ বিষয়ে সাহায্য করতে হয়। সব নিয়মনীতি দেখে তাদের বোঝাতে হয়, বলতে হয়, হিয়ারিং দিতে হয়। এসব কারণেই প্রক্রিয়াগুলোকে একটির পর আরেকটি ধরতে হচ্ছে। এতে কিছুটা সময় লাগছে। তিনি জানান, নরসিংদীর লটকন, যশোরের খেজুরের গুড় জিআই সনদ পাওয়ার পাইপলাইনে আছে। তিনি আরও জানান, জার্নালে প্রকাশের পর আমাদের দুই মাস সময় দিতে হয়। যদি এ সময়ের মধ্যে কোনও আপত্তি আসে, সেজন্য এই অপেক্ষা। এর পরের ধাপই হলো সার্টিফিকেশন।