ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নির্বাচনের আগে নগরবাসীর উদ্দেশে ইশতেহারে ৩৭টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে এসব ইশতেহার বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে মেয়র হিসেবে পার করেছেন তিন বছর, কিন্তু প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন, তা নিয়ে নগরবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
মেয়াদের অর্ধেকের বেশি সময় পার হলেও নগরবাসীকে দেওয়া মেয়র রেজাউল করিমের ৩৭টি প্রতিশ্রুতি এখনও কাগজেই সীমাবদ্ধ। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম যানজট, খাল খনন, ফুটপাত উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশন, মশক নিধন। এসব সমস্যার কোনও অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। এক ঘণ্টা মাঝারি বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় নগরের বেশির ভাগ এলাকা।
দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব সমস্যা থেকে কবে মুক্তি মিলবে, নগরবাসীর কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন এটি। তবে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
বৃষ্টি হলে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় কোথাও কোমরপানি হয়, কোথাও হয় হাঁটুপানি
মেয়রের যত প্রতিশ্রুতি
চসিককে আধুনিক করার জন্য দফা ছিল ৩৭টি। এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজট নিরসন, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, নালা-খাল-নদী থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, নগরীর দখলকৃত খাল, নালা-নদী পুনরুদ্ধার ও পানিনিষ্কাশন উপযোগী করা, যানজট সমস্যা থেকে উত্তরণ, সড়ক শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা, প্রতিনিয়ত মশক নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং হোল্ডিং ট্যাক্সসহ সব ধার্য কর সহনীয় পর্যায়ে রাখা।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি)। এ নিয়ে বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর টাইগারপাসে চসিক ভবনে তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)।
চসিক মেয়রের বাড়িতেও ঢুকেছে বৃষ্টির পানি
যা বলছেন মেয়র
এ নিয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, নগরবাসী সচেতন না হলে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা কখনও সমাধান হবে না। নগরীর অনেক বাসিন্দা আছে ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি ঘরের নষ্ট লেপতোশকও খাল-নালায় ফেলছেন। এ কারণেই খাল-নালায় পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরের বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খালটির খননকাজ চলছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে খনন করা খালটির ভৌতিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬০ শতাংশ। ২০২৪ সালের মধ্যে খাল খননের কাজটি সম্পন্ন করার আশাবাদী। এ খাল খননকাজ শেষ হলে ১০ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে।
মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেনা ছিল। বকেয়া ছিল বিদ্যুৎ বিল ও ঠিকাদারদের পাওনা। দায়িত্ব নিয়ে গত তিন বছরে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা দেনা পরিশোধ করেছি।
তিনি আরও বলেন, শত বাধা উপেক্ষা করে অভিযান চালিয়ে নিউ মার্কেট মোড়ের নালা, রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত করেছি। উদ্ধার করা স্থান রক্ষায় মনিটরিং করা হচ্ছে। পুরো নগরীর ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে। ফুটপাত করা হয়েছে হাঁটার জন্য, এটি দখল করে পণ্য বেচাকেনার করা মানা যায় না। বিশ্বের কোনও সভ্য দেশে ফুটপাত দখলের এমন হীন কর্মকাণ্ড নেই। ফুটপাতের হকারদের জন্য আমরা হলিডে মার্কেট করবো। হকাররা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পণ্য বিক্রি করবে।
বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের কাজ শেষ হয়নি ৯ বছরেও
বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, বর্তমানে যে দোকানপাট আছে, তার কোনোটাই আমার সময়ে হয়নি। এমনকি চুক্তিও হয়েছে আগের মেয়রের সময়ে। যে নগরীতে নিশ্বাস ফেলার কোনও জায়গা নেই, সেখানে আবার উদ্যানের মধ্যে কিসের দোকান? আমি চেয়েছিলাম সব দোকান তুলে দিতে কিন্তু দোকান তুলে দিলে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। আমি কোনও দোকান বরাদ্দ দিইনি। আমি উদ্যানকে ব্যবহার করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ার পক্ষে নয়। যেহেতু বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, সেহেতু আমি চাইছি যতটুকু আছে তারই মধ্যে সাজাতে।
২০ তলা নিজস্ব নগর ভবন নির্মাণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, আমার বাকি দুই বছর মেয়াদে পুরো না হলেও পাঁচ-ছয় তলা ভবন উঠে যাবে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে স্থায়ী নগর ভবনের কাজের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করা হবে।
৩৭টি ইশতেহার প্রসঙ্গে চসিক মেয়র বলেন, আমার নির্বাচনি ইশতেহারে ৩৭টি দফা ছিল। দফাগুলোর কথা আমার মনে আছে। ইতোমধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করছি। চট্টগ্রাম নগরীকে স্মার্ট সিটি করার কাজ করছি। দিন শেষে সব কাজ হয়তো শেষ করতে পারবো না। তবে নির্বাচনের আগে ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো সূচনা করে দিয়ে যাবো।
নগরীর জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পায় না পানি ভবন
অর্থের নয়ছয়, নেই সুফল
নগরীর মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা এস এম শহিদুল্লাহ বলেন, চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। গত তিন বছরে প্রতিশ্রুতিমতো এই সমস্যার সমাধান দিতে পারেননি মেয়র। এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরী ডুবছে, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ফলে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে অর্থের নয়ছয় করছে। কিন্তু কার্যকর কোনও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। আমরা নগরীর জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।
বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ তালুকদার বলেন, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সমস্যা তো আছেই। সে সঙ্গে নগরীর সড়কে যানজট বেড়েছে সীমাহীন। সড়কজুড়ে রিকশা ও ব্যাটারি রিকশাসহ নানা রকম অবৈধ যানবাহন। যেগুলোর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।
জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরীবলেন, বর্তমান মেয়েরের তিন বছর পূর্তির বিষয়টি আলোচনা করার মতো বিশেষ কিছু নয়। সিটি করপোরেশনের রুটিন কাজ রাস্তা-ঘাট, খাল-নালা, পরিষ্কার রাখা, সড়কবাতি জ্বলছে কি না তদারকি করা। কিন্তু গত তিন বছরে করপোরেশনের উন্নতি দূরে থাক, উল্টো অবনতি হয়েছে বেশি। তিন বছরে নগরীতে উল্লেখযোগ্য কোনও উন্নয়ন হয়নি। এমনকি নগরবাসী হিসেবে উল্লসিত হওয়ার মতো কোনও কাজই নেই।
কয়েক বছর ধরে অপরিষ্কার ও সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে চট্টগ্রামের নালা ও খাল
তিনি আরও বলেন, চসিক হচ্ছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সেবা খাত। অথচ প্রতিষ্ঠানটি এখন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী ও সচিবকে বদলির পরও চসিক ছাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ঠিকাদারি ব্যবসা করছে। দুর্নীতির দায়ে চসিক ছেড়েছে, এমন ব্যক্তির জন্য মেয়র সুপারিশ করেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে মেয়রের অবস্থান দুর্নীতি বিরুদ্ধে নাকি দুর্নীতিবাজদের পক্ষে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন তিনি।