ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ চট্টগ্রামে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। পাহাড় কাটা, মানব পাচার, বন্যপ্রাণী পাচার, প্রাণঘাতী মাদক ইয়াবা-ফেনসিডিল-আইস ব্যবসা, মানুষের জায়গাজমি, ঘরবাড়ি দখল, ফুটপাত ব্যবসা, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রব্যবসা এবং প্রকাশ্য ও নীরব চাঁদাবাজিসহ প্রায় সব ধরনের অপকর্মের নেপথ্যে কোনো না কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবিধারীদের নাম শোনা যায়। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি জন্মসনদ নিয়ে নাগরিক হয়ে যাচ্ছে অসৎ জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায়।
পুলিশ বলছে, শুধু পারিবারিক সহিংসতা ছাড়া বাকি প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কথিত ‘বড় ভাই’ পুলিশের কাছে তদবির করে। অপরাধীদের সঙ্গে একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের সখ্য রয়েছে। তারা বড় কোনো অপরাধ ঘটানোর আগে স্থানীয় থানা থেকে সবুজ সংকেত নেয়। থানায় নিয়মিত মাসোহারা দেয় বলে পুলিশকে খুব একটা তৎপর দেখা যায় না। ফলে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে আইনের আশ্রয় পান না। থানা থেকে তাদের আদালতে যেতে বলা হয়। অপরাধীদের নেটওয়ার্ক আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত। অপরাধীদের আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট আইনজীবীও রয়েছে। তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা, জামিন পাইয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের আইনি সহযোগিতা দেয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করলে তারা পালটা মামলা দিয়ে নিরীহ লোকজনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে।
চট্টগ্রামে সরকারের কোনো পদক্ষেপেই বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা। নগরীর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে রাতারাতি পাহাড় কেটে নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হচ্ছে এই ওয়ার্ডের আকবরশাহ এলাকায়। পরিবেশ অধিদপ্তর গত দুই বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ আদালতে ৩২টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০টি মামলা হয়েছে আকবরশাহ ও সংলগ্ন মাঝেরঘোনা এলাকায় পাহাড় কাটার কারণে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড় কাটা চলে মূলত সাময়িক বহিষ্কৃত উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের নেতৃত্বে। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। পরিবেশ অধিদপ্তরের করা তিনটি মামলায়ও তাকে আসামি করা হয়েছে। জানা গেছে, উত্তর পাহাড়তলী মৌজায় ৩৫টির মতো পাহাড় ছিল। ২০টির অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে ১৫টি পাহাড় আংশিক বা অর্ধকাটা অবস্থায় রয়েছে। পাহাড় কেটে প্লট, ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। নগরীর এই ওয়ার্ডেই সবচেয়ে বেশি লোক পাহাড়ের ঝুঁকিতে বসবাস করেন। এক, দুই ও তিন নম্বর ঝিল, বিজয়নগর, জিয়ানগর এবং বেলতলীঘোনা এলাকায় অন্তত ৪০ হাজার লোক অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাস করেন বলে জানায় জেলা প্রশাসন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আকবর শাহ থানার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১০.৫১ একর জায়গা জুড়ে থাকা পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করে। এরপর হাইকোর্ট ঐ পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও স্থানীয় কাউন্সিলর পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখেন।
নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছেন কাউন্সিলররা। এক প্রভাবশালী ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্তাধীন রয়েছে। তার পালিত কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। নতুন বাড়ি নির্মাণ, ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদার নির্ধারিত রেট রয়েছে। পুরোনো ফ্ল্যাট কিনলে ২ লাখ টাকা, জমি কেনাবেচার সময় মোট মূল্যের শতকরা পাঁচ ভাগ, দোকান চালু করতে গেলে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়। নতুন ফ্ল্যাট বা দোকান কেনাবেচা হয় কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যস্থতায়। তাদের চাঁদা না দিলে বাড়ির কাজ করা যায় না। এসব ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করেও লাভ হয় না। চট্টগ্রামের আরেক কাউন্সিলর সরকারি খাসজমি দখল করে দোতলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন। নগরীর রাস্তাঘাটের আবর্জনা পরিষ্কার করা সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব হলেও অনেক কাউন্সিলর এটা নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। নগরবাসী আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনকে ট্যাক্স দিলেও কিছু কিছু কাউন্সিলর নাগরিকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে নিজস্ব লোক দিয়ে বাসাবাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করেন।
ইয়াবাসহ যে কোনো ধরনের মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে চট্টগ্রাম। পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামের অন্তত তিন জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর পরোক্ষভাবে মাদক ও অস্ত্রব্যবসায় জড়িত। কয়েক বছর আগেও যাদের নুন আনতে পান্তা ফোরানোর মতো অবস্থা ছিল, তারা এখন দামি ফ্ল্যাটে থাকেন, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। পুলিশ বলছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলার অনেক চেয়ারম্যান-মেম্বার ইয়াবাব্যবসা করেন। আবার স্থানীয়দের অভিযোগ, ইয়াবা পাচারকারীদের না ধরে নগদ যা পাওয়া যায়, তা হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করে চাকরি করে যাচ্ছেন। রেব ও কোস্ট গার্ডের অভিযানে মাঝে মাঝে ইয়াবার চালান আটক হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুব নগণ্য। সড়ক ও সমুদ্রপথের পাশাপাশি বর্তমানে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী ট্রেনেও ইয়াবা পাচার শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। ইয়াবা পাচার রোধে কক্সবাজার স্টেশনে তল্লাশি জোরদারের পাশাপাশি স্ক্যানার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার এক বাসিন্দা জানান, ঐ উপজেলার কয়েক জন জনপ্রতিনিধি সরাসরি ইয়াবাব্যবসায় জড়িত।
নির্বাচন কমিশনের কঠোর নির্দেশনার পরও মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পৌঁছে যাচ্ছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ভোটার হয়ে যাচ্ছেন। সারা দেশে ইসির সতর্কতাও কাজে আসেনি। এ নিয়ে তদন্তে নেমে ইসি দেখেছেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জন্য জন্মসনদ ইস্যুকারী, মা-বাবা পরিচয়ধারী এবং নাগরিক সনদ প্রদানকারীরাই দোষী। অসৎ জনপ্রতিনিধিদের কারণেই রোহিঙ্গারা এনআইডি পেয়ে যাচ্ছে। আর তা দিয়ে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে। জানা গেছে, জনপ্রতিনিধি ও ইসির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশ করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ইসির প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভৌগোলিক কারণে চট্টগ্রামে পুলিশের কাজ অনেক চ্যালেঞ্জিং। এখানে পাহাড় কাটার সমস্যা যেমন আছে, তেমনি আছে মানবপাচারের সমস্যা। এর পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসাসহ সাধারণ অপরাধগুলো তো আছেই। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের বহুমাত্রিকতাও বাড়ছে। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া বিশাল এই মহানগরীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কাজ বেশ কঠিন। সিএমপি কমিশনার জানান, জনগণকে আরও উন্নত সেবা দিতে সিএমপির পরিধি বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার অংশ হিসেবে নগরীতে আরও আটটি নতুন থানার প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।