DMCA.com Protection Status
title="৭

ওয়াশিংটন কি বাংলাদেশের জন্য নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গত গ্রীষ্মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে লালগালিচা পেতে দেয়ার আগে, ইউএস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) এর কৌশলগত যোগাযোগের সমন্বয়কারী, এডমিরাল জেনারেল জন কিরবি বলেছিলেন, “বাংলাদেশে আমরা ভারতীয় সরকারকে ছাড় দিয়েছি বাংলাদেশের সঙ্গে এর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপার কথা বলার জন্য কিন্তু আমরা যে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চাই তা নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিস্কারভাবে আমাদের আকাংখা ব্যক্ত করেছি। 

আলাদাভাবে দেখলে, বিবৃতিটা কিছুটা পথভ্রষ্ট মনে হতে পারে, কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, 'মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে গণতন্ত্র স্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু' করা হয়েছিল।

ডামি নির্বাচন 

২০২৪  সালের ৭ জানুয়ারী ঢাকায় একটি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা ডামি নির্বাচন নামে পরিচিতি পায়। সেখানে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। একদলীয় শাসিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্র হিসেবে এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভাগ্যে সিলমোহর মেরে দেয়। নির্বাচনের এক মাস পর, হাসিনার শীর্ষ বেসামরিক কর্মচারী মাসুদ বিন মোমেন রাষ্ট্রপতি জোসেফ আর বাইডেনের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পান, যাতে 'বাংলাদেশের সাথে কাজ করার আগ্রহ' প্রকাশ করা হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক চিঠি দেয়ার মাধ্যেম, যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র প্রচারের’ নীতি থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে?

সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ. জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের পর অন্তত কোনো বাস্তব পদক্ষেপের অভাব কাউকে কাউকে ভাবতে বাধ্য করছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র-প্রবর্তন এজেন্ডা থেকে পিছিয়ে গেছে কিনা। হাসিনার কাছে হোয়াইট হাউসের চিঠিটি সেই বোঝাপড়ার গুরুতর প্রমাণ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপসমূহ 

নির্বাচনের আগ পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশ কয়েকটি বিবৃতি এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যাতে গত আড়াই বছরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে একটি অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য,মার্কিন কর্মকাণ্ডগুলো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শুরু হয়েছিলো। এই  কুখ্যাত আধাসামরিক বাহিনীকে জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং হত্যা সহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের বেশ আগে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন 'গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার' অপরাধে বাংলাদেশি নাগরিকদের মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি ঘোষণা করেছিলেন।

মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ স্পষ্ট করতে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু, বাংলাদেশে একটি টিভি টকশোতে হাজির হন। অন্যদিকে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং এনএসসির মুখপাত্র বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মার্কিন অবস্থানকে বারবার নিশ্চিত করেছেন।

ইতিমধ্যে, হাসিনার মন্ত্রীরা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ভারত তাদের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য মার্কিন চাপ থেকে বেঁচে যেতে সাহায্য করতে পারে। যদিও ধারণা করা হয়েছিল যে দিল্লি ওয়াশিংটনকে ভারতকে এর আশেপাশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে জড়িত না হতে রাজি করাবে। ঢাকা দিল্লিতে টু প্লাস টু সংলাপের ঠিক পরে ডোনাল লুর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলিকে সংলাপের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছিল। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই চিঠিটির পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে হাসিনার কোর্টেই বল ছিল বলে মনে করা হয়েছিল।

সম্ভবত চিঠিতে ইতিমধ্যেই 'থ্রিসি' ভিসা বিধিনিষেধের সাথে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে ঢাকা যদি অনেকের মতে অবাধ নির্বাচন আয়োজন করতে অস্বীকার করে তবে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের মুখোমুখি হতে পারে। এত কিছুর পর, 'ডামি নির্বাচন' শেষ হয়েছে এবং এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা রাষ্ট্রপতি বাইডেনের কাছ থেকে 'এক সাথে কাজ করার আগ্রহের' চিঠি পেয়েছেন।

'গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন করা', যা অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়নি, এর জন্য হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো মার্কিন পদক্ষেপ দেখা যায়নি । বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে মোটামুটি দশ শতাংশ লোক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

জরুরী প্রশ্ন 

যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট গুঞ্জন তৈরি করেছে এবং ভোটের পরে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি, তাই এটি সাধারণ পাঠক এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে 'গণতন্ত্রের প্রচার' নীতি পরিবর্তন করেছে? কারণ হাসিনা দিল্লির প্রিয় সন্তান।

এই ধরনের একটি প্রকৃত প্রশ্নের একটি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি পেতে, পাঠকদের কিছু কারণে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।

ওয়াশিংটনের নীতি সময়ের অক্সিজেন, আজকাল, মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাগুলি খেয়ে ফেলছে। দ্বিতীয়ত, এমনকি যদি যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করতে চায় যা এই অঞ্চলে গণতন্ত্র এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করার জন্য হাসিনা সরকারকে শাস্তি দিচ্ছে বলে মনে হয়, ওয়াশিংটনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সব প্রধান মিত্ররা হাসিনার প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতায় আরোহনকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত রয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোয়াইট হাউস ব্রিফিংয়ের একই মঞ্চ একই বার্তার সাথে অনুরণিত হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধারের আহ্বান।

৫ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল 'থ্রিসি' ভিসা বিধিনিষেধ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, "এই নীতিগুলির কার্যকারীতা  কারণ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কারনে শেষ হয়ে যায়নি"

ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঢাকায়  মাঠ কার দখলে তা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন প্রয়োজন।

বাংলাদেশে আপাত মার্কিন নিষ্ক্রিয়তাকে ‘কম শক্তির বর্ধিত সময়কাল’ হিসাবে পড়া যেতে পারে কারণ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য উচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং সেই সাথে নভেম্বরে সেদেশে নির্বাচনের জন্য বাড়ানো হবে।

ভারতের সমস্যা 

ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি নীতিগত সময় দিতে না পারলেও, কৌশলগত অগ্রাধিকারের কারণে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা কঠিন হতে পারে। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ন কিয়াউকফিউ সামুদ্রিক বন্দর পুনরায় চালু করা, চীনকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেবে। এই বন্দরে চীনের ৭০ শতাংশ হিস্যা আছে যা কার্যত দেশটিকে এর মালিক বানিয়ে দিয়েছে। এর থেকে অদূরে, বিএনএস শেখ হাসিনা (একটি নতুন নৌ ঘাঁটি যা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছে), চীন দ্বারা পরিচালিত, যার লক্ষ্য  'সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজের জন্য নিরাপদ জেটি সুবিধা' দেওয়া। 

এগুলো চীন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যতোটা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্যই ঢাকার জন্য ততোটা নয়। তবে, দেশে গণতন্ত্রের অভাব দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অংশীদারের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত অস্বস্তি নিয়ে এসেছে। কয়েক হাজার কর্মী এবং নেতা কারাগারে থাকা অবস্থায় হাসিনার বিরোধী দলগুলি পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য আত্মদর্শন করছে, কিছু স্বল্প পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মালদ্বীপে ঘটে যাওয়া 'ইন্ডিয়া আউট' প্রচারাভিযানের অনুকরণে ভারতকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছে। বয়কটের প্রভাব মূল্যায়ন করার সময় এখনই হয়নি, তবুও এটি এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে যে ভারতের প্রতিবেশী নীতিগুলি ব্যর্থ হলো কিনা এই নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন।

দিল্লি তার পররাষ্ট্র সচিবকে এবার ঢাকায় না পাঠালেও, যা হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য ২০১৪ সালে করা হয়েছিল, এবার ভারতীয় প্রভাব স্পষ্টভাবে স্পষ্ট ছিল। জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি সাধারণ অনুভূতি প্রতিবেশী দেশটির পক্ষে অনুকূল নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের তাৎপর্যপূর্ণ পশ্চাদপসরণ যাই হোক না কেন, সেই পতনের সহায়ক হিসেবে ভারতকে দায়ী করা অবশ্যই জনসংযোগ বৃদ্ধি নয়। এভাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের কর্মকাণ্ড বা নিষ্ক্রিয়তার পরিণতি দিল্লিকে ভোগ করতে হবে।

(The Wire থেকে ভাষান্তরিত। মুশফিকুল ফজল আনসারি স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং জাস্ট নিউজ বিডি এবং সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভসের হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেন্ট এবং জার্নালিজম নেটওয়ার্ক, ইনক (সংগঠিত অপরাধ ও দুর্নীতি রিপোর্টিং প্রকল্প) এর ফেলো হিসেবে কাজ করছেন।)

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!