ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ এ অঞ্চলে ভারতের মাতবর হয়ে ওঠার খায়েশ একেবারে মিটিয়ে দিয়েছে মালদ্বীপ। চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু বলে দিয়েছেন, ১০ মে’র পর ভারতের কোনো সৈন্য উর্দি পরা অবস্থায় কিংবা সাদা পোশাকে তার দেশে থাকতে পারবে না। মাত্র পাঁচ লাখ নাগরিকের একটি ছোট্ট দেশ, যার অবস্থান সাগরের নীল জলে, সেই মালদ্বীপ ভারতের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বলে দিল ‘ইন্ডিয়া আউট’। যে মালদ্বীপকে একদিন ডাকাতের কবল থেকে রক্ষা করেছিল ভারত-তাকেই কিনা বলে দিল ‘আউট’। কেন এমন হলো?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, ভারতের ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে আজ মালদ্বীপ তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভারত কখনো কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। তারা ব্যক্তি, পরিবার কিংবা দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। যার ফলে সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, তারা ভারতের বিরুদ্ধে চলে যায়। মালদ্বীপেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। মোদির বিজেপি সরকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. সলিহর সঙ্গে। তাতে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। ঠিক সেই সময় জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মোহাম্মদ মুইজ্জু ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন নিয়ে ভোটের মাঠে নেমে পড়েন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার এ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হন মো. মুইজ্জু। ইন্ডিয়া একবারে আউট এবং রণতরী নিয়ে চীন ইন। চীনের এই অবস্থান সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে। এখন থেকে মালদ্বীপের নিরাপত্তায় থাকবে চীনা রণতরী।
২
ভারতীয় সাংবাদিকদের বড় খায়েশ ছিল ভারত এই অঞ্চলের মাতবর হয়ে উঠুক। সে নিরিখেই তারা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয় শঙ্করের প্রতি। নয়া দিল্লিতে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারত এ অঞ্চলের মাতবর হয়ে উঠছে কিনা। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ভারত মাতবর হলে তার প্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত? তার হিসাব মতে, এ পর্যন্ত প্রতিবেশীদের জন্য ভারত সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে। তবে তার ভাষায় ভারত এ অঞ্চলের জন্য একটা ফ্যাক্টর; সেটা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হোক আর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণেই হোক; ভারতকে গুনতে হবে।
কিন্তু ভারত এশিয়া অঞ্চলের জন্য এখন একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তবে সেটা বাংলাদেশের জন্য নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখলকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ভারত একেবারে পূজনীয়। শেখ হাসিনা যতদিন আছেন, ততদিন ভারতকে অন্য কিছু চিন্তা করতে হবে না। নিজের নাক কেটে হলেও তিনি ঠিকই ভারতকে জায়গা করে দেবেন। তবে এ সুযোগ গ্রহণ করা ভারতের জন্য এক সময় অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে। সেই বিষয়টি আলোচনায় আসবে, তবে তার আগে নেপাল নিয়ে দুটি কথা বলে আসি।
ভারত তার প্রতিবেশী নেপালে ঠিক মালদ্বীপের নীতিই অনুসরণ করেছিল। নেপালের ন্যাশনাল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ছিল। সেখানে ভারতের আধিপত্য এতটা বিস্তৃত ছিল যে, এক সময় মার্কিন কিংবা নেপালি মুদ্রার চেয়ে ভারতীয় মুদ্রার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সরকার পরিবর্তনে নেপালি জনগণের মতামত ছিল একেবারে গৌণ। এভাবে দীর্ঘদিন চলার পর নেপালের জনগণ এক সময় ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পুস্প দাহাল প্রচন্ড’র নেতৃত্বে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা গ্রহণ। একই ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে শ্রীলঙ্কাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। শুধু হাতছাড়া নয়, একজন প্রধানমন্ত্রীকেও হারাতে হয়েছে। ভুটানও ধীরে ধীরে চিনমুখী হওয়া শুরু করেছে। ভারতের এখন শেষ ভরসা বাংলাদেশ। যেভাবে হোক না কেন বাংলাদেশকে তার চাই। সে জন্য এখানে গণতন্ত্র থাক বা না থাক পছন্দের সরকার দরকার, পছন্দের দল দরকার, পছন্দের মানুষ দরকার।
এই একচোখা নীতি নিয়ে ভারত সেই ২০০৭ সালে ১/১১-এর মতো নাটক সৃষ্টি করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করে। ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতের সহায়তায় একটা নিখুঁত নীলনকশা প্রণয়ন করেন। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিজের অধীনে নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা ভোটে সরকার গঠিত হলেও, সেই সরকার টিকে ছিল কেবল ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর জন্য কম চেষ্টা করে নাই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। কিন্তু সেখানেও ছিল ভারতের প্রচণ্ড বাধা। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন হাসিনা সরকারের ক্ষমতার নবায়ন ছাড়া আর কিছু নয়।
৩.
আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভারতের প্রভাব এত প্রবল যে, এখানে কে এমপি হবেন, কে মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন কিম্বা কে বাদ পড়বেন সেটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা ভারতের। ভারতের প্রভাব শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নয়, সেটা এখন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও চরমভাবে প্রোথিত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে যে সেনা অফিসার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, আর পেছনে প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল এ ভারতের। বিডিআর-এর সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম বাংলা আউটলুকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকরে বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সেদিনের ঘটনায় দিল্লির হুমকিতে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ঢুকে যায়। দিল্লির ধারণা ছিল, সেই সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট-এর মতো একজন উচ্চভিলাসী সৈনিক। পিলখানায় সেদিনের হত্যাযজ্ঞ দমনের সুযোগ যদি সেনাবাহিনীকে দেওয়া হতো, তাহলে মইন উ আহমেদ ক্ষমতার মসনদে বসতেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তো;
এমনটাই আশঙ্কা করেছেন ভারতেরই এক নাগরিক। যা পাওয়া যায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর প্রফেসর অবিনাশ পালিওয়াল’র লেখায়। যাই হোক সেনাবাহিনী যখন ব্যারাকে ফিরে গেল, তখন আর শেখ হাসিনাকে পেছন ফিরে তাকাতে হলো না। আর জীবনের ঢাল হয়ে থাকল ভারত।
আর ভারতও এ সরকারের কাছ থেকে তাদের সব হিসাব- কিতাব বুঝে নিচ্ছে। যখন যা ইচ্ছা তা নিয়ে নিচ্ছে। যেকোনো কাজে আওয়ামী লীগ সরকারকে পাশে পাচ্ছে ভারত। সে কারণে ভারতকে গুনছে আমেরিকা। আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সফল করে তুলতে এ অঞ্চলে ভারতকে মোড়ল হিসেবে মানতে চাচ্ছে। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে চীনকে মোকাবেলা করতে গেলে ভারতকে কাছে পাওয়া জরুরী। কিন্তু ভারত কি আসলেই চীনের সঙ্গে টক্কর দিয়ে পারবে? ঠিক এ মুহূর্তে চীনের সঙ্গে ভারতের কতগুলো ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার একটা হিসেব দিলেই কিন্তু বুঝা যাবে।
১. সরাসরি ভারতের সীমান্ত লাদাখে চীনের হাতে যে প্যাদানি খেয়েছে সেই ঘা কিন্তু এখনো তারা শুকিয়ে উঠতে পারে নাই। ২. চীনের বহুল আলোচিত বিআরআই উন্নয়ন মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে নেপাল। এর ফলে ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নেপাল। ৩. ভারত, ভুটান এবং চীনের সংযোগস্থল হচ্ছে ডোকলাম। ভুটানের সঙ্গে এই ডোকলাম নিয়ে চীনের বিরোধে ভুটানের পক্ষ নিয়েছে ভারত। কিন্তু চীন অর্থকড়ি ঢেলে ভুটানের সঙ্গে সেটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। ৪. শ্রীলংকার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ইতিমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ৫. এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে মিয়ানমার নিয়ে। যাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। যুক্তরাষ্ট্র এ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মিয়ানমারে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে চীন। মিয়ানমারের সরকার এবং যুদ্ধরত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে চীনের। গোটা মিয়ানমারের ওপর রয়েছে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য। সামরিক জান্তাকেও অর্থকড়ি- অস্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করে চীন; আবার গেরিলাদেরও অস্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করে চীন। শুধু সুচির ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আমেরিকার। কিন্তু তারা এ মুহূর্তে খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। চীনের এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার হচ্ছে রাখাইন প্রদেশ দিয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করা। আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে চীনকে এখানে আটকে দেওয়া। আর এ কাজে আমেরিকার দক্ষিণ হস্ত হবে ভারত। আমেরিকার এ স্ট্র্যাটেজি আফগানিস্তানের মতোই ধরাশায়ী হবে।