ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ভারত রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। এর ফলে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি হলো বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। এর কোনো ভালো দিক নেই বলেও জানান তারা।
এই আইন বাস্তবায়নের ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে দুটি বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের দ্বারা সংখ্যালঘু হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের প্রবণতা বাড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম সম্প্রদায়ের হিন্দু রাষ্ট্র ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হতে পারে।
সোমবার ভারতে পাস হওয়া এই আইনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বাংলা বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দেশে কোনো আইন হতে পারে এর কোনো নজির ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার নজির বিশ্বের কোথাও নেই। ভারত নিজেদের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দাবি করে আসছিল, সেই পথ এখন বন্ধ হয়ে গেল। ভারতকে আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলা যাবে না।
তিনি বলেন, এই আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে, তাদের জন্যও এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করলো। তাদেরকেও জড়ানো হলো। এর ভালো কোনো দিক নেই। যে কোনো আইনে সমতার কথা বলা থাকে। নাগরিকরা সবকিছুতে সম-অধিকারপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু আইনটির মাধ্যমে ভারতকে শুধু হিন্দুদের রাষ্ট্র বানানো হলো বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই কূটনীতিক।
সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন বলেন, নাগরিকত্ব প্রাপ্তির দুটি দিক (আসপেক্ট) থাকে। একটি হচ্ছে পুশ-ব্যাক অপরটি পুল-ব্যাক। পুল-ব্যাক হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে কোনো দেশে যাওয়া এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ। আর পুশ-ব্যাক হচ্ছে ক্ষুধা-দারিদ্র, কর্মহীনতা বা যে কোনো সংকটের কারণে কোনো দেশে আশ্রয় নেওয়া।
এই আইন বাস্তবায়নের ফলে ভারতের প্রতিবেশী যে রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় রয়েছে তাদের মধ্যে পুশব্যাক প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। একইভাবে ভারতে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য এক ধনরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করলো।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যান্তরেও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের প্রবণতা বাড়তে পারে। কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা চিন্তা করতে পারেন একসময় এই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে নাগরিকত্ব নিয়ে নেবে। তাদেরকে যত দ্রুত তাড়ানো যায় তত তাড়াতাড়ি তাদের সম্পদ দখলে নেওয়া যাবে। সেই প্রবণতা থেকে তাদের ওপর নিপীড়ন বাড়তে পারে।
একইভাবে ভারতের অভ্যান্তরেও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের প্রবণতাও বেড়ে যাবে।
২০১৪ সালে এই আইনটি যখন প্রথম আলোচনায় আসে তখনই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী এটি নিয়ে বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছেন। এখনো সেটাই করা উচিৎ বলেই মনে করেন এই দুই কূটনীতিক। তাদের মতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই আইনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং, এই আইন নিয়ে ভারতের সাথে শক্ত অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা জরুরি।
উল্লেখ্য, আইনটি পাস হওয়ার চার বছর পর সোমবার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বাস্তবায়ন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। আইনটি নিয়ে প্রচুর আইনি বিবাদ আছে। আইনটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গেই আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিরোধিতা শুরু হয়েছে। বিরোধিতা হচ্ছে কেরালায়। যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট- সিপিআইএম এবং তামিলনাড়ুতে, যে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ডিএমকে।
পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় আইনটি বিরোধিতার কারণ বড়সংখ্যক মুসলমান ভোটার। সিএএতে সংখ্যালঘু মুসলমান ছাড়া অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নাগরিকত্ব পাবে। তামিলনাড়ুতে বিরোধিতার প্রধান কারণ মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার তামিলদেরও নাগরিকত্বের সুযোগ না দেওয়া। এই তিন রাজ্যে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে যে ধরনের প্রতিবাদ হচ্ছে, তা কিন্তু অন্য রাজ্যের এমনকি কংগ্রেস শাসিত রাজ্যেও এখনো হয়নি।