DMCA.com Protection Status
title=""

পল্লবীতে দুর্ধর্ষ গ্যাং গ্রুপের রাজত্ব, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় বেপরোয়া

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ উনিশ বছরের তরুণী নাজরার চোখে জল। রোববার দুপুর; রাজধানীর পল্লবীর সি ব্লকের মুড়াপাড়া ক্যাম্পের ৫ নম্বর লেনের বাসায় নীরবে কাঁদছিলেন তিনি। রোজার পর স্থানীয় তরুণ মো. ফয়সালের সঙ্গে ঘর বাঁধার কথা ছিল তাঁর। দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তাও চূড়ান্ত হয়েছে বেশ কয়েক দিন আগে। নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন নাজরা। গত শনিবার ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে পল্লবীর গ্যাং-গ্রুপের হামলায় প্রাণ হারান ফয়সাল (২৩)। মুড়াপাড়া বিহারি ক্যাম্পের বাসার অদূরে তাঁকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। পেশায় কারচুপি কারিগর ছিলেন তিনি। শুধু ফয়সালের ঘটনা নয়; নানাভাবে পল্লবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্ধর্ষ সব গ্যাং-গ্রুপ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানকার পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে বেপরোয়া তারা। রোজা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন মহল্লায় গ্যাং-গ্রুপের সদস্যরা নিয়মিত ‘শোডাউন’ দিয়ে আসছে।
মুড়াপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, নাজরাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন স্বজনরা। তিনি জানান, শনিবার বিকেল ৪টার দিকে মুড়াপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা তানজিলা আক্তারের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয়েছিল ফয়সালের। ওই দিন নামাজ পড়তে গিয়ে কয়েলের আগুনে ওড়না পুড়ে যায় নাজরার। শনিবার বিকেলে বাসার সামনে হবু স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয় ফয়সালের। এ সময় ফয়সালের সঙ্গে তাঁর বন্ধু রানুও ছিলেন। ওড়না পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে নাজরাকে বকা দেন ফয়সাল। এরপর এ নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন। এ সময় প্রতিবেশী তানজিলাও সেখানে ছিলেন। তানজিলা ধরে নিয়েছিলেন, ফয়সাল, রানু ও নাজরা তাঁকে নিয়ে তামাশা করছিলেন। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি থেকে ফয়সালের সঙ্গে তানজিলার কথাকাটাকাটি হয়। এর পর ক্ষুব্ধ হয়ে ছোট্ট একটি বাঁশের লাঠি তানজিলার দিকে ছুড়ে মারেন ফয়সাল। তবে সেটি তাঁর গায়ে লাগেনি। এ ঘটনার পর ফয়সালকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন তানজিলা। এ বিরোধ থেকেই তানজিলার স্বামী আকাশ, তার বন্ধু কালু মিয়া, তানজিলার বড় ভাই শাহীনসহ ১০-১২ জন ফয়সালের ওপর হামলা করে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন দিন আগে তানজিলার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে নাজরাকে নিয়ে গান গেয়েছিলেন ফয়সাল। ওই সময় তানজিলা ধরে নেন, তাঁকে ব্যঙ্গ করে ফয়সাল গান গেয়েছেন। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। স্থানীয় লোকজনও দু’জনকে নিবৃত্ত করেন। সর্বশেষ শনিবার বিকেলে ফের তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। স্থানীয় কয়েকজন জানান, ফয়সালের সঙ্গে মাদক কারবারে বিরোধ নিয়ে রাব্বীসহ কয়েকজনের পূর্ববিরোধ ছিল। তারাও এই হত্যা মিশনে ছিল।

মুড়াপাড়া ক্যাম্পে নিজের বাসায় বিলাপ করছিলেন ফয়সালের মা লিলি খাতুন। প্রতিবেশীরা তাঁর মাথায় পানি দিচ্ছিলেন। লিলি বলেন, ‘চার সন্তান ছিল আমার। একজনকে ওরা কেড়ে নিল। দোষীদের ফাঁসি চাই।’ ফয়সালের বাবা শাহাদত হোসেন তাঁত কারখানায় কাজ করেন। তাঁর চার ছেলের মধ্যে তৃতীয় ফয়সাল।

শনিবার ইফতারের পরপরই পল্লবীর বি ব্লকের ২১১ নম্বর বাড়ির সামনের সড়কে ফিল্মি কায়দায় হামলার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের স্বজন ও পুলিশ জানায়, ফয়সাল তাঁর বন্ধু রাশেদকে নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ইফতার পার্টিতে যান। সেখান থেকে তারা অটোরিকশায় বাসায় ফেরার পথে হামলা হয়। ঘটনার সময় রাস্তায় খুব বেশি লোকজন ছিল না। যানবাহনও চলছিল কম। গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কে রক্তের দাগ। ইট দিয়ে জায়গাটি ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। যে বাসার সামনের ঘটনা, সেই বাসার দারোয়ানের ছেলে হাসান শেখ বলেন, ‘ইফতারের পরপরই হঠাৎ রাস্তা থেকে চিৎকার শুনতে পাই। দৌড়ে গিয়ে দেখি, রক্তাক্ত অবস্থায় একজন রাস্তার ওপর ছটফট করতেছে। একটু দূরে আরেকজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে।’
সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, অটোরিকশার গতি রোধ করে দুই তরুণকে নামিয়ে মারধর শুরু হয়। একজনকে রাস্তার একদিকে নিয়ে যায়। আরেকজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। শনিবার ঘটনার পর রমজানী নামের একজন ফয়সাল ও তাঁর বন্ধুকে রাশেদকে হাসপাতালে নেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফয়সালকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। স্বজনরা জানান, কেন ফয়সাল ও রাশেদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিল– এ কারণে হত্যার সঙ্গে জড়িত রাব্বী ফোন করে রমজানীকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে।

এদিকে নিহত ফয়সালের ‘গুরু’ ছিলেন মো. সানি ওরফে পেপার সানি। শিষ্যকে মেরে ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত রাব্বী ওরফে গলাকাটা রাব্বীর ই ব্লকের বাসায় রোববার রাতে হামলা করেছে গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। দলবদ্ধ হয়ে বাসা ভাঙচুর করে সানির সাঙ্গোপাঙ্গ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক দিন ধরেই সন্ধ্যার পর পল্লবীতে কিশোর গ্যাং-গ্রুপের সদস্যরা মহড়া শুরু করে। দলবদ্ধ হয়ে মোটরসাইকেলে তারা ঘুরতে থাকে। দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দেয়। পল্লবীর বি ব্লকে যে জায়গায় ফয়সালকে হত্যা করা হয়েছে, সেই এলাকায় তিন দিন ধরে টানা মহড়া দেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের পাশে গভীর রাত পর্যন্ত তারা আড্ডা দেয়। স্থানীয়রা বলছেন, পল্লবীতে পুলিশ সক্রিয় হলে কয়েক দিন পরপরই খুনোখুনি-মারামারি হতো না। এলাকায় আধিপত্য, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজি ছাড়াও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বারবার সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা।
পল্লবী ঘুরে যেসব গ্যাং-গ্রুপের তথ্য পাওয়া গেছে, এর মধ্যে আশিক অন্যতম। তার বাবা খালেকুজ্জামান ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। লালমাটিয়ায় আশিক ও অনিক গ্রুপের দাপট। শনিবার আশিক ও তার সঙ্গীরা স্থানীয় বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বাবুলের ছেলে সিয়ামকে মারধর করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে শহীদুল ও তাঁর স্ত্রী শাহীনুর বেগমকে পিটিয়ে আহত করে আশিক। তাদের কাছ থেকে স্বর্ণের চেইন ও ৬০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আশিকের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে রয়েছে রাব্বী, পিন্টু, চাঁদ, আপ্পিক, সজীব, পারভেজ, ইমন, সোহেল ও রোমান। এ ছাড়া গ্যাং-গ্রুপে ওই এলাকায় আরও যারা আছে তাদের মধ্যে রয়েছে সায়মন, আক্কাস ওরফে টান আক্কাস, স্বপন, রাজন, ব্লেড বাবু, হাবিব ও বাবু। এ ছাড়া পল্লবীতে সক্রিয় ‘ভাস্তে গ্রুপ’; এই গ্রুপ চালায় শান্ত।

শনিবার যেখানে ফয়সালকে হত্যা করা হয়, ২০২২ সালের একই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয় রাকিবুল নামে এক স্কুলশিক্ষার্থী। নৃশংস হামলার পর থেকে পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে ওই কিশোর। রোববার রাকিবুলের বাবা মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ছেলের ওপর হামলার বিচার এখনও পাইনি। আসামি জামিনে বের হয়ে এখন মাঝে মাঝে পথরোধ করে ভয় দেখায়। পল্লবীতে গলিতে গলিতে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট। পুলিশ নজর দিলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। আমার ছেলের ওপর যেখানে হামলা হয়েছিল সেখানেই আরেক মায়ের সন্তানকে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।
এর আগে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ২০২১ সালের ১৬ মে ছয় বছর বয়সী শিশুর সামনে যুবক সাহিনুদ্দিনকে (৩৩) কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের ইন্ধনে এ খুন হয়েছিল। এম এ আউয়াল ইসলামী গণতন্ত্রী পার্টির চেয়ারম্যান। তিনি খুনের মামলায় জামিনে রয়েছেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয়। পিবিআই, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‍্যাব তখন জানিয়েছিল, এই হত্যাকাণ্ডের পর একটি অডিও ক্লিপ তাদের হাতে আসে। সেখানে শোনা যায়, হত্যাকারীদের একজন আউয়ালকে ফোন করে বলছে, ‘স্যার, ফিনিশ।’ তখন ওই ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে দেখা যায়, দুই যুবক চাপাতি দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে কোপাচ্ছিল।

পল্লবী থানার ওসির দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান জানান, ফয়সাল হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দু’জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান ওসি।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের দাপটের বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের ব্যাপারে ওসি বলেন, কেউ এমন অভিযোগ করলে আমার কী করার আছে। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!