ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। এতে সরকারি দল বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। বিরোধীদের দমন করার পাশাপাশি বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রতিকূল।
বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে চূড়ান্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)।
আইআরআই এবং এনডিআই হলো নির্দলীয় ও বেসরকারি দুটি সংস্থা। তারা বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অনুশীলনকে সমর্থন ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজ করে। গত ৩০ বছরে ৫০টিরও বেশি দেশে সম্মিলিতভাবে ২০০টিরও বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে তারা।
নির্বাচনের সময় আইআরআই ও এনডিআই-এর যৌথ প্রতিনিধি দলের পাঁচজন সদস্য বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তারা নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকর্তা, নিরাপত্তাকর্মী, রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক, বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
মার্কিন এই দুই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনি সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছে, ভবিষ্যতে নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি প্রশমন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং নিজেদের তুলনামূলক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্য অংশীজনদের কাছে সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি ছিল। ক্ষমতাসীন দলকে সুবিধা দিতে অসম বিধি প্রয়োগ করা হয়েছে। বিরোধীদের দমন করা হয়েছে, যা ন্যায়সঙ্গত ছিল না। আইন প্রয়োগকারীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে। ভোট নিয়ে নারী ও দুর্বল গোষ্ঠী উচ্ছেদ আতঙ্কে ছিলেন। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো দমন-পীড়নের ভয়ে সেল্ফ সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, মিশন সদস্যরা দেখতে পেয়েছেন- ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রচারণার সময় ও নির্বাচনের দিনসহ অন্য সময়ে আগের নির্বাচনের তুলনায় সহিংসতা হয়েছে কম। দেশজুড়ে কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি ছিল।
এনডিআইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মনপ্রীত সিং আনন্দ বলেছেন, এই প্রতিবেদন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের একটি মূল্যবান রোডম্যাপ হিসেবে অবদান রাখবে। অহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল, সরকার এবং নাগরিক সমাজসহ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নেতাদের নির্বাচনী রাজনীতির নিয়ম, অনুশীলন ও আইন সংস্কার করার প্রয়োজন আছে।
শনিবার এ বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এতে বলা হয়, এনডিআই এবং আইআরআই সারা বিশ্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোকে নিরীক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক ও কারিগরি বিশ্লেষক দল নিয়োগ করে। আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপারিশ করে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আগে ৮ থেকে ১১ অক্টোবর আইআরআই এবং এনডিআই একটি প্রাক নির্বাচন মূল্যায়ন (পিইএএম) সম্পন্ন করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পিইএম- নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী ও অন্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক মহলের দলগুলোর নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নাগরিক নির্বাচক পর্যবেক্ষক দলের নেতাসহ সংসদের নারী সদস্য, যুব, প্রতিবন্ধী, ব্যক্তি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি, মিডিয়া প্রতিনিধি, আইনি সম্প্রদায়ের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি এবং কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। মিশন শেষে পিইএএম পাঁচটি সম্পাদনাযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছে।
সেগুলো হলো- মধ্যপন্থি রাজনৈতিক বক্তৃতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা, অহিংসতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা এবং একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষেবা এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান বারবার অসমভাবে নির্বাচনী বিধি প্রয়োগ করেছে। বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত বা ব্যাহত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা সন্তোষজনক ছিল না, ন্যায়সঙ্গত ছিল না এবং এর ফলে নির্বাচনকালীন সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ধারণা তৈরি হয়েছিল।
নির্বাচনী সহিংসতা প্রথমত দুইভাবে ঘটেছে। যার প্রথম রূপটি ছিল প্রার্থী এবং সমর্থকদের প্রতিযোগিতার মধ্যে। নির্বাচনী এলাকায় প্রচারাভিযান কেন্দ্রিক নির্বাচনী সহিংসতা যা সাধারণত আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ছিল, যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাবেক প্রার্থীদেরও টার্গেট করা হয়েছে। যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখ্য ছিল সমর্থকদের গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, প্রচার মিছিলে হামলা, প্রচার কার্যালয় ধ্বংস বা অগ্নিসংযোগ, মৌখিক হুমকি, এবং ভাংচুর বা সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ।
সহিংসতার দ্বিতীয় রূপটি ছিল বিরোধীদের বয়কট প্রচেষ্টার দ্বারা, যদিও বিরোধী দল ধারাবাহিকভাবে অহিংসার আহ্বান করেছে, নির্বাচন ঠেকাতে এর সমাবেশ, অবরোধ এবং ধর্মঘটের কৌশলের কথা বলেছে। তারপরেও অগ্নিসংযোগ, শারীরিক হামলা, ভাংচুর, ভীতি প্রদর্শনসহ সহিংসতা মাঝে মাঝে ঘটেছে এবং একজন পুলিশ অফিসারের মৃত্যুও ঘটেছে। প্রাান্তিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী এবং হিন্দুরাও নির্বাচনী সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে।
প্রতিবেদন এবং অংশীজনদের প্রতিক্রিয়ায় পাওয়া যায় যে, নারীদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী সহিংসতা অতীতের তুলনায় কম ছিল। টিএএম দেখেছে যে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পূর্ণভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। এতে প্রতীয়মান হয় যে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং তাদের সক্ষমতা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এই নির্বাচনে মহিলা প্রার্থীরা টিএএমকে বলেছেন যে, তারা অপমানিত হয়েছেন এবং জনসমক্ষে এবং অনলাইনে হুমকি, বিশেষ করে পুরুষ প্রতিপক্ষ এবং তাদের অনুগামীদের কাছ থেকে এবং বলেছেন যে রাষ্ট্র কর্মকর্তারা তাদের অভিযোগের জবাব দেননি। অংশীজনরা আরও উল্লেখ করেছেন যে নারী ভোটার ও অন্য দুর্বল গোষ্ঠীর ভোটাররা ভোট দেওয়ার জন্য অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হয়েছিল, যার মধ্যে উচ্ছেদ বা রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার হুমকি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুরাও উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে। বিগত নির্বাচনের তুলনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী সহিংসতা কম ছিল। হিন্দু জনগোষ্ঠী এবারও উল্লেখযোগ্যভাবে ভীতি ও সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে বিশেষভাবে প্রচারণার সময়ে।
বিশিষ্ট সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলিতে এবং ক্ষমতাসীন দল এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কের সমালোচনামূলক বিবৃতি ও প্রতিবেদনের জন্য কিছু জায়গা অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাই হোক, অংশীজনরা আরও উল্লেখ করেছেন যে সরকারের প্রতিশোধ নেওয়ার ভয়ে মিডিয়া সেল্ফ সেন্সরশিপ করেছে।