ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দীর্ঘদিনের অনিয়ম দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করার কারণে ব্যাংক খাতের আজকের দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। এখন বড় ঋণখেলাপি, ব্যাংক লুটেরা ও অর্থ পাচারকারীদের বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খারাপ ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংক একীভূত করা হলে তা হবে উদ্বেগের। আবার একীভূত করার পর দুর্বল ব্যাংকের মন্দ ঋণ কে কিনে নেবে, তা পরিষ্কার করতে হবে। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থায়নে গঠিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এসব ঋণ কিনে নিলে তার দায় এসে পড়বে জনগণের ওপর।
গতকাল শনিবার ‘বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রভাব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এমন অভিমত দেন অর্থনীতিবিদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ওয়েবিনারে আলোচক ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান। প্রবাসী সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান। সমাপনী বক্তব্য রাখেন গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রধান ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতের দুরবস্থার বিষয়টি অনেক দিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। এ খাতের সংস্কার যত দেরি হবে, প্রতিদিনের জন্য তাতে ক্ষতি হবে। তবে ব্যাংক একীভূত করার আগে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা করতে হবে। তা না করে কুখ্যাত ব্যাংকের সঙ্গে হঠাৎ করে একটি ভালো ব্যাংক একীভূত করা হলে তা হবে উদ্বেগের। কেননা, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে একটি ব্যাংক ভালো অবস্থায় টিকে আছে। সেখানে দুর্বল ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ, তার নিজস্ব সংস্কৃতি, মানবসম্পদ, তারল্য পরিস্থিতির কারণে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কঠিন হবে। তড়িঘড়ি না করে সব দিক বিবেচনা করে একীভূতকরণ করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক খাত সংস্কারে আইএমএফের শর্তের কারণে একীভূতকরণের বিষয়টি লোক দেখানো চেষ্টা কিনা। আবার দুর্বল ব্যাংক যে পরিমাণ খেলাপি ঋণের তথ্য দিচ্ছে, প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে খারাপ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিভিন্ন কারণে যে কোনো উদ্যোগ নিয়ে সন্দেহ থাকে। এখন একীভূতকরণের ক্ষেত্রে প্রকৃত খারাপ অবস্থার ব্যাংক বাদ দেওয়া হবে। নাকি আসলে দুর্বল, তবে পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী তাদের ব্যাংক একীভূত না করে অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালীদের ব্যাংক একীভূত করা হবে, সে আলোচনা সামনে এসেছে। সুশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হলে এসব আলোচনা আসত না। আবার বলা হচ্ছে, খারাপ ব্যাংকের মন্দ ঋণ একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি কিনে নেবে। অথচ এ বিষয়ে এখনও আইন করা হয়নি। তাহলে কীভাবে কিনবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ফলে ব্যাংক একীভূতকরণ সফল না হলে সমস্যা জিইয়ে থাকবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ব্যাংক খাতের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন করা উচিত। এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন করতে হবে, যারা সাহস নিয়ে ভালো কিছু পরামর্শ দিতে পারেন। প্রস্তুতি ছাড়া শুধু লোক দেখানোর জন্য কিছু করলে, সেটা টেকসই হবে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। একটি রাজনৈতিক দল অনেক দিন ক্ষমতায় থাকলে তার খারাপ দিকও আছে। আবার ধারাবাহিকতার কারণে কিছু করার সুযোগও থাকে।
অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের বিপর্যস্ত অবস্থা এক দিনে হয়নি। সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা থাকলে কখনও এত খারাপ অবস্থায় আসত না। এখন সরকারের টাকায় যদি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করা হয়, সেটা খারাপ হবে। ১০-১৫ বছর ধরে যারা লুটপাট করল, অর্থ পাচার করল; করের টাকায় তাদের সম্পদ কিনে নিলে তার দায় জনগণকে নিতে হবে। সুতরাং ব্যাংক একীভূতকরণের পাশাপাশি লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মূল প্রবন্ধে জিয়া হাসান বলেন, ব্যাংক খাতের যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে একীভূতকরণের বিকল্প নেই। তবে এখন যে উপায়ে একীভূত করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের বাঁচাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের তথ্য লুকানোর সুযোগ দিয়ে এসেছে। ফলে খেলাপি ঋণের আসল চিত্র অজানা। এখন ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে ভালো ব্যাংকও দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। সেটা না করে খারাপ ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবসায়ক নিয়োগ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শরিয়াহভিত্তিক খারাপ ব্যাংক মিলে একটি, প্রচলিত ধারার বেসরকারি খারাপ ব্যাংক মিলে একটি এবং সরকারি খারাপ ব্যাংক মিলে একটি করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, মন্দ ঋণের দায় কে নেবে, সেটা পরিষ্কার নয়। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি সব মন্দ ঋণ কিনে নেবে বলে বলা হচ্ছে। এখন এই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠিত হবে কার অর্থায়নে। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে হলে মুদ্রা সরবরাহে প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। একই সঙ্গে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর করের বোঝা পড়বে। সুতরাং বেসরকারি অর্থায়নে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি করলে অন্তত তার দায় জনগণের ওপর পড়বে না।
সাংবাদিক মনির হায়দার বলেন, ফারমার্স থেকে পদ্মা ব্যাংক করেও ব্যাংকটিকে বাঁচানো গেল না। তবে ব্যাংকটিকে এই অবস্থার আনার পেছনে যারা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেসিক ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটের প্রধান অভিযুক্ত আব্দুল হাই বাচ্চুর কিছুই হয়নি। খারাপ অবস্থার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু ব্যাংক একীভূতকরণ করলে কোনো লাভ হবে না। আবার টেকসই ব্যবস্থার মাধ্যমে না করে তড়িঘড়ি করেও কোনো সুফল আসবে না।