ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ব্যাপক প্রভাবাশালী, হিমশীতল করা ভয়ংকর, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি, অনিময়ম ও ভোগ-বিলাসের চিত্র প্রকাশ করেছে সরকারপন্থী এক পত্রিকা। ওই পত্রিকার মালিকপক্ষের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিজেদের মধ্যে কোন্দল, দলাদলি ও ব্যবসায়িক দ্বন্দের কারণে সম্ভবত বেনজীরের কুর্কীতি প্রকাশ্যে এসেছে। এমন না যে বেনজীরের ‘কর্ম’ সম্পর্কে আমরা কেউ ওয়াকিবহাল ছিলাম না। এদিক-ওদিক কান পাতলেই বেনজীরের নানা অপকর্মের কথা শোনা যেত। শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ্যে এসেছে।
বেনজীর আহমেদকে নিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘কালের কণ্ঠ’ প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি প্রতিবেদন করেছে। এ ছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান ইফতেখার আহমেদের মন্তব্যও প্রকাশ করেছে। ফলে বুঝাই যাচ্ছে, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে কালের কণ্ঠ বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল। আর ঢাকা থেকে প্রকাশিত আরেকটি পত্রিকা ‘প্রতিদিনের বাংলাদেশ’ কালের কণ্ঠের মালিকপক্ষ বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধেও সংবাদ প্রকাশ করে। সে সব সংবাদেও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করছে এরা সবাই বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এবং সবাই ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের আনুকূল্য পেয়ে আসছে। এখন এসব ওলিগার্কদের মধ্যে নানা কারণে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব হতেই পারে। কিন্তু এর মধ্যে বেনজীর আহমেদ প্রবেশ করলেন কীভাবে? এটা চিন্তার বিষয়। তিরি সরকারি চাকুরে ছিলেন। তার এই বিশাল পরিমাণ সম্পদের উৎস কী? এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একজন সরকারি চাকুরের পক্ষে কী এ পরিমাণ সম্পদ অর্জন করা সম্ভব! বেনজীর আহমেদ বিশাল বিত্তশালী পরিবারের সদস্য এমনটাও শুনিনি।
কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পর দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। অনেকে এমনও বলেছেন, সংবাদে বেনজীর আহমেদের সম্পদের কিয়দংশরই বিবরণ এসেছে। দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে আরো সম্পদ আছে। এটা ঠিক সমসাময়িক কালে দুর্নীতি করে অনেকে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বেনজীর আহমেদেরও বিদেশে সম্পদ আছে কি-না আমরা জানি না। তবে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে অনেকে অনুমান করছেন, তার বিদেশেও সম্পদ থাকতে পারে।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হতে পারে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ব্যবসায়ীদের কোনো এক পক্ষকে তিনি সহযোগিতা বা আশ্রয় দিয়েছেন। যে কারণে তাকে নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে কালের কণ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করেছে। আমরা এসব বিষয়ে আর বেশি আলোচনা না করি। আগেই বলেছি ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব থাকেই। শুধু আমাদের দেশে না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বড় বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা থাকে। এক সময় এ প্রতিযোগিতা ক্ষতিকর দ্বন্দ্বেও রূপ নিতে পারে। এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটনা গড়ায়।
কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে বেনজীর আহমেদকে নিয়ে কালের কণ্ঠ সংবাদ প্রকাশের সাহস পেল কোথায়? অনেকে বলবেন, গণমাধ্যমের কাজই তো সাহসের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করা। খুব সত্য কথা। কিন্তু আমাদের দেশে এখন কতটা সাহসের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশিত হয় তা ভেবে দেখতে হবে। অনেক কিছু হচ্ছে, ঘটছে কিন্তু তার পুরোটা প্রকাশ্যে আসছে না। আমরা সবাই এটা জানি। কিন্তু বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে কী এমন হলো যে ভয় কাজ করছে না। অথচ অভিযোগ রয়েছে, দেশে গুম ও বিনাবিচার হত্যার অন্যতম কুশীলব এই বেনজীর আহমেদ। মহাপরিদর্শক থাকাকালে পুলিশকে এক দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করেছেন। সেই দানবীয় পুলিশ এখনো তাণ্ডব বজায় রেখেছে। বিরোধী দল ও মতের হাজার হাজার মানুষকে জেলবন্দী করা, নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেওয়াসহ অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সঙ্গে বেনজীর আহমেদ বা পুলিশ জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের নিয়ে কেউ টু শব্দ করার সাহস পেত না। এখন সেই বেনজীর আহমেদকে নিয়ে সরকারপন্থী পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রায় পুরো অংশ জুড়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে!
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ মানেই সরকারে বিরুদ্ধে যাওয়া। কারণ এটা যুক্তিসঙ্গত যে, সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তিনি এতদূর এসেছেন। নিজে নিজে এতদূর আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাকে সংবাদ প্রকাশ ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করে। অনেকে জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে এ সংবাদ নিয়ে। ঢাকার এক সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চমৎকার একটি বাক্য লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো ধর্মেই অস্তমিত সূর্যের পূজা হয় না। তবে কী বেনজির আহমেদ অস্তাচলের দিকে যাত্রা করেছেন। তাকে এখন আর আওয়ামী লীগের দরকার নেই! বরং তাকে এখন পরিত্যাগ করাই আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক। এমনকি গুম, খুনের দায়ে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ ফায়দা নিতে পারে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য? বর্হিবিশ্বকে দেখাতে পারবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িতদের আমরা বিচার করেছি। এ রকম ভোল পাল্টানোর উদাহরণ রাজনীতিতে আকছার আছে।
এসবই আগাম অনুমান। কিছুটা কল্পনাও বলতে পারেন। এমনটা নাও হতে পারে। হবেই না বলে আমরা মনে করি। কিন্তু বেনজীর আহমেদ যদি জীবিত থাকেন এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে; জনসাধারণ যদি রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরে পায়। এটা ৫, ১০,১৫, ২০ পরে হলেও একদিন এই দেশে আওয়ামী লীগসহ বেনজীর আহমেদদের গুম, খুনের দায়ে বিচার হবে এটা নিশ্চিত। তখন গণমাধ্যমের এ প্রতিবেদনগুলো সাক্ষী হিসাবে বিবেচিত হবে।
ড. মারুফ মল্লিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক