ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি দুটি কার্গো বোয়িং ৭৪৭-৪০০ বিসিএফ বিমান তেল আবিবের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। গত ৭ এপ্রিলে অভূতপূর্ব এবং গোপনীয় দুটি ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন ইসলামী দল থেকেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। অতি দ্রুত এর রহস্য উম্মোচনের জোর দাবি উঠেছে। ন্যাশনাল এয়ার কার্গো ইনকর্পোরেটেড ইউএসএ দ্বারা নিবন্ধিত ও পরিচালিত পণ্যসম্ভার বিমানটি (ফ্লাইট নম্বর ঘ ৮৮০৬) ৭ এপ্রিল ১৯২৩ ঘন্টা উড়ে তেল আবিব থেকে ঢাকায় অবতরণ করে এবং একই দিনে ঢাকা ছেড়ে যায়।
ফ্লাইট নম্বর ঘ ৮৮৪৮ (এনসিআর ৮৪৮) এর অধীনে একই কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত দ্বিতীয় ফ্লাইটটি ১৯৫৪ ঘন্টা উড়ে ১১ এপ্রিল সরাসরি তেল আবিব থেকে ঢাকায় আসে এবং ১২ এপ্রিল ঢাকা ছেড়ে যায়। যদিও দুটি ফ্লাইটই সরাসরি তেল আবিব থেকে ঢাকায় এসেছিল।
যদিও বাংলাদেশ ও ইসরাইলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, জরুরি অবতরণ ছাড়া বাংলাদেশে পণ্য বহনকারী ইসরায়েলি ফ্লাইটের অবতরণ একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
কারণ দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং বাংলাদেশ ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। তারা অতিদ্রুত তদন্তপূর্বক এই ঘটনার রহস্য উম্মোচনের দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিমানবন্দরে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহির্ভূত ইসরায়েলি দুটি বিমানের অবতরণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
একইসঙ্গে অবিলম্বে ইসরায়েলি বিমান অবতরণের বিষয়ে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেছে সংগঠনটি।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, যে রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, সেই রাষ্ট্রের বিমানের অবতরণ রহস্যজনক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
তিনি বলেন, গাজায় গণহত্যাকারী মানবতার দুশমন ইসরায়েলের দুটো কার্গো বিমান কোন কারণে, কি উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে অবতরণ করলো এবং অবতরণের পর তারা কি কাজে সময় ব্যয় করেছে তা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন কূটনৈতিক সম্পর্কহীন একটি রাষ্ট্র হতে ঢাকায় বিমান অবতরণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খেলাফত মজলিস।
এক যুক্ত বিবৃতিতে খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড: আহমদ আবদুল কাদের উদ্বেগের সাথে বলেন, ইসরাইল হচ্ছে একটি অবৈধ রাষ্ট্র যার সাথে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বর্বরতা ও দখলদারিত্বের কারণে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। সেই হিসাবে ইসরাইলের সাথে সরাসরি কোন ধরণের যোগাযোগ বাংলাদেশের থাকার কথা নয়।
অথচ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যায় ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব থেকে সরাসরি দু’টি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করে আবার রাতের অন্ধকারেই ঢাকা ত্যাগ করে।
ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মাওলানা এরশাদ উল্লাহ ভুইয়া, নায়েবে আমির অধ্যাপক শওকত হোসেন, নায়েবে আমির মাওলানা রুহুল আমিন, নায়েবে আমির ডঃ মাওলানা এনামুল হক আজাদ এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মোস্তফা তারিকুল হাসান এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ইসরাইলি দুটি কার্গো বিমানের অবতরণকে অত্যন্ত আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ সরকার এক দিকে ঘোষণা করেছে ইসরাইলের সাথে তাদের সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার, অপরদিকে তারা ইসরায়েলি বিমানকে এইভাবে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়াকে এক ধরনের জাতির সাথে প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন জাতি জানতে চায় এই বিমানের কাজ কি ছিল? কেনইবা তারা এখানে অবতরণ করে এবং কি দিয়ে গেল আর কি নিয়ে গেল তা জাতির কাছে স্পষ্ট করার জন্য আহ্বান জানান।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম বলেন, ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি ইসরাইলকে।
কিভাবে দুইটি কার্গো বিমান বাংলাদেশে অবতরণ করেছে? বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ জানতে চায়। শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। জমিয়ত মহাসচিব আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন রাষ্ট্রে মাজলুম ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বক্তব্য রাখছেন। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণও ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমর্থন জানিয়েছে।
ইসরাইলের অন্যায় ও জুলুম বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। কার স্বার্থে ইসরাইলের বিমান অবতরণের সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিমানবন্দর । সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা দেশ বিরোধীদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, ইসরাইল একটি অবৈধ ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র যার সাথে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, দেশের মানুষ জানতে চায় ইসরাইলের বিমান কেন ও কি উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অবতরণ করেছে এবং কি নিয়ে গেছে।
ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের সর্ম্পক জনগণ কোনোভাবেই সহ্য করবে না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সকলেই যখন প্রিয়জনদের সাথে ঈদের ছুটি কাটাচ্ছেন ঠিক তখনই গোপনে ৭ ও ১১ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ঢাকায় ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর (যা তেল আভিভে অবস্থিত) হতে দুটি বোয়িং ৭৪৭-৪০০ বিসিএফ অজ্ঞাত কার্গো (পণ্য) সহ অবতরণের বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য দেশবাসী জানতে চায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ার কার্গো বা ন্যাশনাল এয়ারলাইনসের পরিচালিত কার্গো বিমান গুলো সরাসরি তেল আভিভ থেকে ঢাকায় পৌঁছলেও ঢাকা ত্যাগ করার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ বিমান বন্দরে অবতরণ করে।
বিমান দুটি বাংলাদেশ থেকে কি নিয়ে শারজায় অবতরণ করেছে তাও সুস্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে কোন রকমের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্বেও কেন বিমান দুটি অবতরণ করল তা দেশবাসীর সামনে রহস্যময়। সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘ইসরায়েল রীতিমতো প্যালেস্টাইনে গণহত্যা চালাচ্ছে’, তিনি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনাও করেন। তার কয়েকদিন পরেই দুটি বিমানের অবতরণ জনমনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা এবং বাংলাদেশ ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় একমাত্র জরুরি অবতরণ ব্যতিত ইসরায়েল থেকে পরিচালিত কোন ফ্লাইটের বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে অবতরণ একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা। অনতিবিলম্বে সরকার এ ঘটনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে সরকার মুখে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে সে জারজ ইসরাইলের একান্ত আস্থাভাজন সহযোগী।
কূটনৈতিক কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলের দুটো বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে কেন অবতরণ করেছে তা জাতি জানতে চায়।
মানবতার চরম শত্রু, দখলদার রাষ্ট্র ইজরাইলের পতাকাবাহী বিমানের অবতরণ অতি রহস্যজনক এবং জাতীয় ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি স্বরূপ বলে মনÍব্য করেছেন বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মন্তব্য করেছিলেন যে, ইসরাইল রীতিমত প্যালেস্টাইনে গণহত্যা চালাচ্ছে। আবার সেই ইসরাইলের বিমান বাংলাদেশে অবতরণের অনুমতি প্রদান চরম দ্বিমুখিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইতিপূর্বেও ইসরাইলের নিকট থেকে নজরদারী সরঞ্জাম কেনার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের নিকট দেশকে বিতর্কিত করা হয়েছে। ইরান-ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি চলাকালীন সময়ে এরকম ঘটনা দেশের নিরাপত্তাকে চরম সঙ্কটে ফেলতে পারে। বিএনপির সিনিয়র নেতা মেজর হাফিজ একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এনিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যায় মদদ দিচ্ছে আমেরিকা এবং ভারত। আর ভারত আমাদের প্রভু সেজে বসে আছে।
যেখানে সরকারের কোন দায়বদ্ধতা নেই, মানুষের অধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই সেখানে আমাদের শত্রু, মুসলমানদের শত্রু ইসরাইল মাথা গুজবে, অবাধে বিচরণ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়।