DMCA.com Protection Status
title="৭

কফিনে ফিরল ‘ইউরোপের স্বপ্ন’

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সাগর পেরিয়ে একবার ইউরোপে যেতে পারলে কোটি কোটি টাকা আয়ের সুযোগ– এই প্রলোভনে হাজারো বাংলাদেশির মতো ঘর ছেড়েছিলেন আট তরুণ। ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে তারা যান লিবিয়া। সেখানে কিছু দিন থাকেন দালালদের আস্তানায়। এর পর বিশাল ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পাঠাতে তাদের তুলে দেওয়া হয় ছোট নৌকায়। তবে ইউরোপের মাটিতে আর পা ছোঁয়াতে পারেননি তারা। সাগরপথেই হয়েছে তাদের স্বপ্নের সমাধি।

কীভাবে এই আট তরুণের মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। প্রথমে জানা গিয়েছিল, নৌকাডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্বজন এবং ফিরে আসা জীবিতদের ভাষ্য, নৌকায় জায়গা না থাকায় মারধর করে ওই তরুণদের পাঠানো হয় পাটাতনের নিচে। দম বন্ধ হয়ে সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। এ অভিযোগে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলাও হয়েছে।

জীবিত ফেরত আসা ১১ জনের একজন মাদারীপুরের রাজৈরের গুরুদাস মণ্ডল। তিনি সমকালকে বলেন, নৌকা ডোবেনি। ওই তরুণরা ছিলেন নৌকার পাটাতনের নিচে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।

নৌকার পাটাতনের নিচে করুণ পরিণতি বরণ করার আড়াই মাস পর গতকাল বৃহস্পতিবার ওই আট তরুণের মরদেহ ফিরেছে দেশে। দুপুর সাড়ে ১২টায় লিবিয়া থেকে বিমানে কফিনবন্দি দেহ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। এ সময় স্বজনের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। পুলিশ পরে মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।

ওই আট তরুণ হলেন– মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সজল বৈরাগী, নয়ন বিশ্বাস, মামুন শেখ, কাজী সজীব ও কায়সার খলিফা এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার শেখ রিফাত, রাসেল শেখ ও ইমরুল কায়েস আপন।

বিমানবন্দরে মামুনের কফিন ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই সজীব শেখ। তিনি জানান, তাঁর ২৪ বছর বয়সী ভাই ইতালি যেতে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে গত ডিসেম্বরে দেশ ছাড়েন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফোনে জানান, পরদিন ‘গেম’ হবে। অর্থাৎ লিবিয়া থেকে নৌকায় ইতালি পাঠানো হবে। একেকটি নৌকায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন ওঠানো হয়। তবে তাঁর ভাইকে পাঠানো হয় ২৫-৩০ জন ধারণক্ষমতার ছোট নৌকায়। অথচ সেখানে মাঝি ছাড়া তোলা হয় ৫৩ জনকে।

ওই নৌকায় থাকা গুরুদাস মণ্ডল বলেন, দালালরা জোর করে ২৫-৩০ জনের নৌকায় ৫৩ জনকে তোলে। জায়গা না হওয়ায় ৯ জনকে নৌকার পাটাতনের নিচে ঢোকায়। তারা বের হয়ে আসতে চাইলে মারধর করে। এর পর পাটাতনের ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। এতে দম আটকে মারা যান তারা। তাদের একজন পাকিস্তানি এবং অন্যরা বাংলাদেশি। নৌকা থেকে ঢেউয়ে ভেসে এক সুদানির মৃত্যুর কথাও জানান তিনি।
নৌকা থেকে পরে জীবিত ৪৪ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করে লিবিয়ার পাশের দেশ তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। তাদের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি। বাকিদের মধ্যে ৮ জন পাকিস্তান, পাঁচজন সিরিয়া ও তিনজন মিসরের নাগরিক। যারা জীবিত ফেরত এসেছেন, তাদের বরাতে সজীব শেখ জানান, আরবিভাষী মিসরীয়রা তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ডকে জানিয়ে ছিলেন, পাটাতনের নিচে লাশ রয়েছে। এর পর জীবিতদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান জানান, দেশে ফিরে দুই বাংলাদেশি ব্র‍্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারাও জানিয়েছেন, নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয়নি; আটজনকে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে বিস্তারিত উঠে আসবে বলে আশা করছি‌।

এদিকে নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগীর মামলায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মানব পাচার প্রতিরোধ আইন মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সজল উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যেতে ইচ্ছুক ছিলেন। পূর্বপরিচিত যুবরাজ কাজী ও লিবিয়ায় থাকা তাঁর বাবা মোশাররফ কাজী ১৪ লাখ টাকায় বৈধ পথে ইতালি পাঠানোর প্রস্তাব দেন। গত ১৭ নভেম্বর যুবরাজের গোপালগঞ্জের বাসায় আড়াই লাখ টাকা এবং পাসপোর্ট দেন সজল। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে সজলের কাছ থেকে আরও পাঁচ লাখ টাকা নেন যুবরাজ। সজল দুবাই পৌঁছানোর পর ৮ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের বাসায় গিয়ে যুবরাজ কাজীর হাতে আরও সাড়ে ছয় লাখ টাকা দেন সুনীল। কিন্তু এর পর থেকে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

এ নিয়ে গুরুদাস মণ্ডল জানান, মোশাররফ হলো চক্রের হোতা। দেশে তাঁর অনেক দালাল রয়েছে। মোশাররফের হয়ে তাঁকে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন গুরুদাস নামে আরেকজন। পরে তিনি যুবরাজকে সাত লাখ টাকা দেন। এখন এ ঘটনার মামলায় যুবরাজ জেলে। আর গুরুদাস শুধু আশ্বাস দিচ্ছেন, টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। অন্যদিকে মোশাররফ জানিয়ে দিয়েছেন, এক টাকাও দেবেন না। উল্টো বলছেন, আমার জন্য নাকি তাঁর ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সুনীল বৈরাগী সমকালকে বলেন, ২০ জনের একটি চক্র মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তরুণদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করছে। না বুঝতে পেরে ছেলেটাকে হারালাম।

এদিকে স্বজনরা গতকালই মরদেহ চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে– এমন সনদ কফিনের সঙ্গে আসেনি। শুক্রবার ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কফিন খোলা হবে। লিবিয়া বা তিউনিসিয়ায় ময়নাতদন্ত হয়ে থাকলে স্বজনের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮, ২০২২ সালে ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছেন ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে অন্তত কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা।

আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বহু নাগরিক অবৈধ পথে ইউরোপ যান। বাংলাদেশিরা কেন যাচ্ছেন? এর প্রধান কারণ– ইউরোপের মোহ। বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে। তবে শুরুতে অভিবাসনপ্রত্যাশীকে বলা হয়, ৭-৮ লাখ টাকা লাগবে। এর পর লিবিয়ায় নিয়ে আটকে আরও ৭-৮ লাখ নেওয়া হয়। টাকা আদায়ে মারধর থেকে খুন পর্যন্ত করা হয়।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!