DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

‘ছেলের লাশের চেয়েও ভারী হয়ে উঠেছে ঋণের বোঝা’

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নিজের শেষ সম্বল ও ধারদেনা করে ছেলে ইমরুল কায়েস আপনকে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন পান্নু শেখ। এ জন্য দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১১ লাখ টাকা। তবে ছেলে আর ইতালি পৌঁছতে পারেননি। লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ট্রলারেই প্রাণ হারান আপন।

আড়াই মাস পর শুক্রবার সেই ছেলের লাশ পেয়েছেন পান্নু। তবে ছেলের শোকের পাশাপাশি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এ বাবার এখন বড় মাথাব্যথা ঋণের বোঝা। নিজে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, একমাত্র ছেলেও মৃত– এখন ধারের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গয়লাকান্দি গ্রামের বাড়িতে বসে শুক্রবার সেই কষ্টের কথাই জানান পান্নু।
 
আড়াই মাস আগে আপনের সঙ্গে একই নৌকায় থাকা আরও সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করেছিল তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। লিবিয়া থেকে লাশগুলো বিমানে দেশে আসে গত বৃহস্পতিবার। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে স্বজনের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।

আগের দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, লাশের ময়নাতদন্ত লিবিয়া বা তিউনিসিয়ায় হয়েছে কিনা– এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজ আসেনি। হত্যা মামলা হওয়ায় ময়নাতদন্ত হয়েছে কিনা, জানা প্রয়োজন।

তবে স্বজনের দাবি ছিল, তিউনিসিয়ায় ময়নাতদন্ত হয়েছে। তাই বৃহস্পতিবারই লাশ চেয়েছিলেন তারা।
 
নিহত মামুন শেখের ভাই সজীব শেখ  বলেন, শুক্রবার ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মর্গে একটি কফিন খোলা হয়। খুলে দেখা যায় ময়নাতদন্ত হয়েছে। তাই বাকি কফিনগুলো খোলা হয়নি। লাশ দিয়ে দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এই গরমে একটা দিন কফিনগুলো মর্গে ফ্রিজ ছাড়া রাখায় লাশগুলো পচে গেছে। শুধু শুধু মরা মানুষগুলোকে কষ্ট দেওয়া হলো।

নিহত আট তরুণের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। তারা হলেন– শেনদিয়া গ্রামের সজল, কদমবাড়ি উত্তরপাড়ার নয়ন বিশ্বাস, স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখ, তেলিকান্দি গ্রামের কাজি সজীব ও কিশোরদিয়া গ্রামের কায়সার। আপনসহ বাকি তিনজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায়। অন্য দু’জন হলেন– বড়দিয়া গ্রামের দাদন শেখের ছেলে রিফাত শেখ ও ফতেপট্টি গ্রামের আবুল কাশেম শেখের ছেলে রাসেল শেখ।

এই তরুণরা সংসারে সুদিন ফেরাতে জমি বিক্রি করে, ঋণ করে অথবা উচ্চ সুদে টাকা নিয়ে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন। তাদের মৃত্যুতে এই পরিবারগুলো শুধু নিঃস্ব হয়নি, বড় অঙ্কের ঋণের বোঝাও চেপেছে তাদের কাঁধে।

আপনের বাবা পান্নু শেখ নিজেও ১৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। ২০১৯ সালে দেশে ফেরার পর একটি প্রতিষ্ঠানে গাড়িচালকের চাকরি নেন। এক বছর আগে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সংসারের আয় বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে তাই ছেলে রাজশাহী এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আপন ইতালি যেতে চান। পরে বাবার জমানো টাকা ও ঋণ নিয়ে ১০ জানুয়ারি ইতালির উদ্দেশে দেশ ছাড়েন আপন। ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাতে আপনসহ আরও ৫৩ জনকে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি ছোট নৌকায় তুলে দেয় দালালরা। পরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আপনসহ আট বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। প্রথমে নৌকাডুবিতে তাদের মৃত্যুর কথা বলা হলেও নৌকাটি থেকে জীবিত উদ্ধার ২৭ বাংলাদেশির একজন গুরুদাস মণ্ডল দেশে ফিরে জানান, নৌকাডুবি হয়নি। নৌকায় জায়গা না হওয়ায় ৯ জনকে জোর করে পাটাতনের নিচে ঢোকানো হয়েছিল। দম আটকে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

আপনের বাবা পান্নু শেখ বলেন, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আশপাশের অনেকেই ইতালি যায়। তাদের সঙ্গে ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম। এ জন্য সঞ্চিত সব সম্বল ও ধার করে দালাল রহিমকে ১১ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে গিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এখন ছেলের মরদেহের সঙ্গে এই ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়ে উঠেছে।

নিহত আরেক তরুণ রিফাত শেখের বাবা দাদন শেখ বলেন, এনজিও থেকে কিস্তিতে ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ছেলের সঙ্গে সেই ১৭ লাখ টাকাও শেষ। এখন দেনার দায়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।

রিফাতের মা দালালদের বিচার দাবি করে বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়।

এদিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পাঁচ যুবকের বাড়িতেও চলছে মাতম। তাদের মধ্যে কিশোরদিয়া গ্রামের কায়সার সর্বস্ব বিক্রি করে এবং সুদে টাকা নিয়ে ছোট দুটি মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী এবং আট ও তিন বছরের দুই মেয়ের এখন কী হবে, তা কেউ জানে না।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!