ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণ ও আমদানি মূল্য পরিশোধে বাজেট সহায়তার জন্য চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম সুদের (সফট লোন) ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। খবরটি ঘাবড়ে যাওয়ার মতো হলেও, অবাক হওয়ার মতো নয় মোটেও।
ঘাবড়াবার কারণ হলো এর আগে চীনের কাছে কম সুদে এত বড় অঙ্কের ঋণ চায়নি বাংলাদেশ। বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। যার বেশিরভাগই বাণিজ্যিক চুক্তিতে রপ্তানিকারকের ঋণ এবং চীনের সর্বোচ্চ দেওয়া ঋণ হলো গত অর্থ বছরে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যদিও দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় সফট লোন চাওয়ার বাংলাদেশের সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার মতো কিছু না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা, জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সরকারকে ঋণ নিতে মাথা খারাপ করে তুলে। কারণ ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থাকায় টাকা দরকার। বাংলাদেশি একটি থিংক ট্যাঙ্কের মতে, এই বাধ্যবাধকতা মেটাতেই আরও ঋণ খুঁজছে সরকার। দেশের ভবিষ্যৎ বন্ধক রেখে সম্ভবত একটি দুষ্টচক্র তৈরি হচ্ছে।
চীনের কাছে বাংলাদেশের ঋণ চাওয়ার খবরটি এমন একসময় চাউর হলো যখন বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করেছে এবং বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তির অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ তৃতীয় কিস্তিতে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পাবে। দেশটি কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করেছে বলে আইএমএফ এই ঋণ ছাড় করেছে। শর্তগুলোর মধ্যে এমন কিছু শর্ত আছে যা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক। যেমন জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। গত বছর বিদ্যুতের মূল্য তিনবার বেড়েছে এবং বছরের শেষ নাগাদ আরও চারবার বাড়বে বলে সরকারের তরফে ঘোষণাও রয়েছে।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ তিনগুণ বেড়েছে এবং ঋণ পরিষেবা বেড়েছে ২ দশমিক ৬ গুণ। দেশীয় ঋণও বেড়েছে। তবে চীনের কাছে এই ঋণ চাওয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—দুই ধরনেই প্রভাবই আছে। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং বিগত বছরগুলোতে তার অর্থনৈতিক প্রভাব দেখানোর বিষয়টি সংবাদমাধ্যম ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (এইআই) গত বছর জানিয়েছে, বাংলাদেশে মোট চীনা বিনিয়োগ প্রায় ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া বিভিন্ন চীনা কোম্পানি বিভিন্ন খাতে ২২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ চুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য খুবই একমুখী। চীন ২০২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ২২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যেখানে বাংলাদেশ দেশটিতে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পাশাপাশি দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ বিশ্বজুড়ে ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে সমালোচিত। এই ঋণ অনেক দেশের জন্য অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণ হয়ে উঠেছে, যা তাদের সার্বভৌম নীতের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করেছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেই চীন থেকে ঋণ নেয় দেশগুলি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীন থেকে ঋণ নেওয়ায় আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থার সঙ্গে ঋণগ্রহণকারী দেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। চীনা ঋণ ও বিভিন্ন প্রকল্পে এর ব্যবহারে স্বচ্ছতার অভাব এবং উচ্চ ইএসজি (পরিবেশগত, সামাজিক, অথবা শাসন) ঝুঁকি গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করে। বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোও এ ধরনের ঝুঁকি মুক্ত নয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা ল্যাব এইডডেটা অনুযায়ী, দেশে বিআরআই প্রকল্পের ৫৯ শতাংশই ইএসজি ঝুঁকি মুখে আছে। গুরুতর ইএসজি ঝুঁকি মোকাবিলা করা প্রকল্পের হার ২০১৫ সালের ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১ সালে নাটকীয়ভাবে বেড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়। আবার এও উল্লেখ্য যে, বহুপাক্ষিক সংস্থার ঋণের তুলনায় চীনা ঋণ পরিশোধে সময় কম পাওয়া যায়।
অভিযোগ রয়েছে, চীনা ঋণের ব্যবহারে কঠোর নজরদারি না থাকায় তা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, চীনা ঋণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার এবং জবাবদিহিতা হ্রাসপ্রবণ। এইডডেটার পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে ২০২২ সালে চালানো এক গবেষণায় আন্দ্রেয়াস কার্ন, বার্নহার্ড রেইনসবার্গ ও প্যাট্রিক ই শেয়া দেখান, চীনা ঋণ এবং আইএমএফের প্রোগ্রামগুলি উভয়ই শাসনের জন্য অত্যন্ত সমস্যাজনক এবং তা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের উৎসাহিত করে।
চীন থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ, বিশেষ করে ঋণে দেশটির প্রভাব বৃদ্ধির রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে। গত এক দশকে সফট পাওয়ার ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দৃঢ় নীতি সহজেই বোঝা যায়। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের পথ আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
এটি মনে রাখতে হবে, এই সিদ্ধান্ত ২০২৪ সালের শুরুতে হওয়া নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে এসেছে। সেই নির্বাচনের আগে আগে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা খুব আলোচিত বিষয় ছিল। তখন শেখ হাসিনা সরকারকে দৃঢ় সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপর জোর দেয়। কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে সমর্থন করা মার্কিন নীতি হিতে বিপরীত হবে, কারণ তা হাসিনাকে চীনের ঘনিষ্ঠ হতে প্ররোচিত করবে।
২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ভারত। সেই ভারত হাসিনার চীনের দিকে সম্ভাব্য ঝুঁকে পড়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা উচিত বলে জোর দিয়েছিল। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির কারচুপির নির্বাচনের পর দৃশ্যতই যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়েছে। ভারতীয় স্পষ্ট যুক্তি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা হাসিনা শাসনের ওপর চীনা প্রভাবকে দূরে রাখবে। যদিও গত এক দশকের অতীত ইতিহাসে সেরকম কোনো সাফল্যের নজির নেই।
বাংলাদেশে ২০০৯ সালের পর ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল। আর ঠিক তখনই বাংলাদেশে চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই বাড়ন্ত প্রভাবের সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছে আসন্ন বাংলাদেশ-চীন যৌথ সামরিক মহড়া এবং তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা। আর এসব কিছুই যে বাংলাদেশে দুই পরাশক্তির (চীন ও যুক্তরাষ্ট্র) ভূ-রাজনৈতিক লড়াই আরও তীব্র হবে তার ইঙ্গিত দেয়।
ঋণ দিতে বাংলাদেশের এই অনুরোধে চীন সাড়া দেবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশি এবং চীনা সরকারের স্বচ্ছতার অভাবের অতীত বলে, বাংলাদেশিরা হয়তো জানতেই পারবে না কী ঘটেছে। তবে এটা খুব ভালো করেই জানা যে, বাংলাদেশের কোনো গোষ্ঠী সরকারকে ব্যাখ্যা করতে বলবে না কেন বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরও চীন থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ যে ঋণ চাচ্ছে তার সঙ্গে কি কি শর্তা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে তাও নাগরিকরা জানতে পারবেন বলে মনে হয় না। এমনকি বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধে বাড়তি চাপ তৈরি হবে জানা সত্ত্বেও নতুন এই ঋণ কেন আগের সুরক্ষিত ঋণের সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে তাও আলোচনা হবে না।
শাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নেই। আর তা-ই যাদেরকে এই আর্থিক ও রাজনৈতিক বোঝা বহন করতে হবে তাদের কোনো কথা না শুনেই সরকারের পক্ষে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে সম্ভব করে তুলেছে।
প্রথম বাংলাদেশ এর পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে ভাষান্তর করা হলো।