DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

ভারতকে টেক্কা, পাকিস্তানের কাছে চীনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাবমেরিন

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ প্রথমবারের মতো পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে চীনের তৈরি উন্নত প্রযুক্তির হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিন। মোট আটটি সাবমেরিনের প্রথমটি ইতোমধ্যে পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে হস্তান্তর করেছে চীন। শুক্রবার এ উপলেক্ষে চীনের উহান শহরের উচাং শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপের শুয়াংলিউ ঘাঁটিতে হয়ে গেলো এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে চীন ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের।

এদিকে, এই সাবমেরিন পাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভারত মহাসাগর এবং  আরব সাগরে কৌশলগত দিক দিয়ে নয়া দিল্লির চেয়ে এগিয়ে গেলো ইসলামাবাদ। বিশ্লেষক ও  ভারতের সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তানকে এই সাবমেরিন দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের পানির নিচে নৌ তৎপরতায় চীনের বিস্তৃত উপস্থিতির তুলনায় নয়া দিল্লি পিছিয়ে পড়ল।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, পাকিস্তানের জন্য নতুন এ গোপন সাবমেরিন নির্মাণ করে ভারতের ওপর চাপ তৈরি করছে বেজিং। যা ভারতকে তার নৌ সক্ষমতা বাড়াতে মরিয়া করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এয়ার-ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালসনের (এআইপি) মতো উন্নত প্রযুক্তি ও  নতুন ধরনের সেন্সর দিয়ে নির্মিত হয় হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিন। যা সাবমেরিনটিকে প্রচলিত সাবমেরিন থেকে বাড়তি সক্ষমতা দেয়। এই সাবমেরিনের সক্ষমতা ভারতের কাছে থাকা সর্বোচ্চ সক্ষমতা সম্পন্ন সাবমেরিন কালভ্যারি শ্রেণি বা স্করপেন শ্রেণির সাবমেরিনের চেয়ে বেশি।

ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ বলেন ডিজেল ইঞ্জিত চালিত সাবমেরিন বা প্রচলিত সাবমেরিনের সঙ্গে এআইপি যোগ হলে তার সক্ষমতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ভারতের কোনো সাবমেরিনই এআইপি প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নয়।

তিনি আরও বলেন, এআইপি প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সাবমেরিনের সঙ্গে কেবল পারমাণবিক আক্রমণকারী সাবমেরিনের তুলনা করা যায়। কিন্তু পারমাণবিক আক্রমণকারী সাবমেরিনও খুব শব্দ করে চলে, যা অনেক দূর থেকে শনাক্ত করা যায়। আমাদের পারমাণবিক সাবমেরিন আছে কিন্তু সেগুলো ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন। পারমাণবিক হামলা না হলে এইগুলো দিয়ে নিয়মিত কাজ চালানো যায় না।

পানির নিচে থাকার ক্ষেত্রেও হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিনের সক্ষমতা বেশি এবং এটি ১০ থেকে ১৪দিন পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে। সেই তুলনায় ডিজেল ইঞ্জিন চালিত সাবমেরিন সাধারণত মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে।

ভারতের কাছে এখন ১৬টি প্রচলিত সাবমেরিন আছে। সম্প্রতি দেশটি বলেছে, এর মধ্যে মাত্র ছয়টি কর্মক্ষম আছে। বাকিগুলোর কার্যকালের সময় প্রায় শেষের পথে। অন্যদিকে, হাঙ্গর শ্রেণির আটটি সাবমেরিন নিয়ে পাকিস্তানের এআইপি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সাবমেরিন হবে ১১টি। দেশটি ২০০৮ সালে তাদের কাছে থাকা আগোস্টা ৯০বি সাবমেরিরেনের তিনটিতে ফ্রেঞ্চ এআইপি সিস্টেম যোগ করে।

অরুন প্রকাশ বলেন, ভারত অনেকদিন ধরেই তাদের বিদ্যমান সাবমেরিনে এআইপি যোগ করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি নৌ বহরে সম্ভাব্য যোগ হবে এমন সাবেমেরিনেও তা যোগ করার চেষ্টা করছে। তার মতে, এআইপি সমৃদ্ধ সাবমেরিন পেতে ভারতের অন্তত ৭ থেকে ১০ বছর লাগবে।  

ভারতের নৌ বাহিনী জার্মানের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থাইসেনক্রাপ মেরিন সিস্টেম এবং স্প্যানিশ নাভান্তিয়ার সঙ্গে প্রজেক্ট৭৫-আই কর্মসূচির আওতায় অন্তত ছয়টি এআইপি প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সাবমেরিন নির্মাণ নিয়ে কথা চালাচালি করছে। এর আগে ছয়টি ফ্রেঞ্চ কালভ্যারি শ্রেণির সাবমেরিন নির্মাণ করতে ভারত মাজাগন ডকস লিমিটেডের (এমডিএল) সঙ্গে কাজ করে। ২০২৩ সালের মে মাসে সেই ছয়টির মধ্যে শেষটি সমুদ্রে পরীক্ষা শুরু হয়।

ভারতীয় নৌ বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা কমোডর সি উদয় ভাস্কর বলেন, চীনের কাছ থেকে পাকিস্তানের সাবমেরিন পাওয়ার এই ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।

নয়া দিল্লি ভিত্তিক থিংক ট্যাংক, সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিসের বর্তমান পরিচালক এবং ভারতের ন্যাশনাল মেরিটাইম ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফেলো ভাস্কর আরও বলেন, পানির নিচে সমন্বিত সক্ষমতা বাড়াতে ভারতের আসলেই কাজ করা উচিত। আর তা শুধু সাবমেরিন নিয়েই নয়, অন্যান্য বিষয়েও। যেমন সেন্সর বা অন্যান্য সম্পদ যেগুলো ভারতকে পানির নিচের সামগ্রিক চিত্র দেবে।

ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব

বছরের পরিক্রমায় ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভার বেড়েই চলছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানকে নতুন প্রযুক্তির সাবমেরিন সরবরাহও এই অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা কৌশলের অংশ।

সিঙ্গাপুরের দি ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর সি. রাজা মোহন বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে ভারত মহাসাগর নিয়ে চীনের আগ্রহ স্পষ্ট। ২০০৮ সালের পর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দিজবুতিতে তারা তাদের প্রথম কৌশলগত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং গত দুই দশক ধরে এই অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি এবং প্রভাব খুব প্রকটভাবে বেড়েছে।

নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বেইজিং বড় ধরনের আধুনিকীকরণের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে মোহন বলেন, চীনের নৌ বাহিনীর আকার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র যে, ভারত মহাসাগরে জাহাজ, গবেষণা জাহাজ ও নিয়মিত বিমানের সংখ্যা বাড়াবে দেশটি।

চীনের সামরিক বাহিনী তার নৌবহরকে প্রায় ৭৮ সাবমেরিন দিয়ে সাজিয়েছে। এর মধ্যে  ৮টি এসএসবিএন (ব্যালিস্টিক সাবমেরিন), ১৩টি এসএসএন (পারমাণবিক আক্রমণকারী সাবমেরিন) এবং ৫৫টি এসএসকে (ডিজেল-ইলেক্ট্রিক সাবমেরিন) রয়েছে।

চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে মোহন বলেন, যদিও পাকিস্তানে চীনের আনুষ্ঠানিক বা কাগজে কলমে কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই, তবে অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে করাচি এবং গোয়াদার বন্দরে চীনা নৌবাহিনীর বিশেষ প্রবেশাধিকার রয়েছে। এসব বন্দরে নিয়মিতভাবেই সাবমেরিন নির্মাণ কাজ চলে।  

সম্ভাব্য আটটি হাঙ্গর শ্রেণির সাবমেরিনের মধ্যে চারটি চীনে তৈরি হবে এবং বাকি চারটি প্রযুক্তি স্থানান্তর কর্মসূচির আওতায় পাকিস্তানের করাচি শিপইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডে তৈরি হবে।  

মোহন বলেন, ভারতের বুঝে নেওয়া উচিত—শুধু ভারত মহাসাগরেই নয়, পাকিস্তানের আশপাশেও চীনের উপস্থিতি বাড়ছে।

ভারতের সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার উপকূলরেখা রয়েছে যার উপদ্বীপের অংশটি ভারত মহাসাগরের দিকে বিস্তৃত এবং পশ্চিমে আরব সাগর এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।  


উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলজিৎ সিং বলেন, পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে চীন নিজেকে শক্তিশালী করছে। চীন ভারত মহাসাগরীয় রাষ্ট্র নয়, তাই তারা পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কারণ ভারত মহাসাগর বা আরব সাগরে চীন এই ধরনের সাবমেরিন তৈরি করতে পারে না।

ভারতীয় নৌবাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে নিবন্ধ লিখা বলজিৎ সিং বলেন, এই ধরনের সাবমেরিন প্রযুক্তি তৈরি করা পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব না। এমনকি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের কথা বললেও বলা যায়, চীনের সহায়তার কারণেই ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক সক্ষমতা দেখাতে পেরেছিল।

তিনি মনে করেন, বেইজিং তার মিত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারতের উপর দক্ষিণ এশিয়ার চাপ তৈরি করছে।

বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বিক্রিতে নজরদারি করা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের দিক থেকে চীন শীর্ষে আছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদের ৮২ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করেছে বেইজিং। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৬৯ শতাংশ।

বলজিৎ সিং বলেন, সাবমেরিন তৈরিতে ভারতের যে গড়িমসি তা কাটি উঠতে পাকিস্তানের পাওয়া হাঙ্গর-শ্রেণির সাবমেরিন চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষত মালদ্বীপে চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর রাজনৈতিক দলের নিরঙ্কুশ জয়ের পর।

নয়া দিল্লির এ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ নিয়ে একই মত পোষণ করেছেন কমোডর ভাস্করও। তিনি বলেন, পানির নিচের নিয়ন্ত্রণের কথা বললে চীন কিন্তু বাংলাদেশকেও পানির নিচে সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করছে। তাই আরব সাগর বলেন আর বঙ্গোপসাগর বলেন, উভয় সাগরের পানিতেই চীনের তৈরি ‘নৌকা’র সাঁতার ভারতের জন্য কৌশলগত চিত্র আরও জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। নৌবাহিনীতে ভারতের আরও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ দরকার।

তিনি বলেন, নৌবাহিনীর জন্য বর্তমান বরাদ্দকৃত তহবিলকে খুবই পরিমিত বলা যায়। নৌ বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে তা মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের মাত্র ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। আগামী পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশে যেতে হলে ক্রমান্বয়ে তা বাড়াতে হবে। তবে তা সহজ হবে না, কারণ সেনা ও বিমান বাহিনীকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য আর্থিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!