ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুসারে সরকার আগামী বাজেটে এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা কমানোর ব্যাপারে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা এরশাদ সরকারের আমলে (১৯৮৮ সালের ২৪ মে এসআরও জারি করে) শুরু হয়। ৩৬ বছর ধরে এমপিরা এই সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন। আগামী অর্থবছরের বাজেটে দীর্ঘদিনের এ সুবিধা কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করে আসছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
গতকাল মঙ্গলবার (১৪ মে) প্রধানমন্ত্রীর কাছে এনবিআর নানা ধরনে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ির বিষয়ে মতামত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনায় আক্রান্ত হওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রধানমন্ত্রীর কার্ষালয়ে বাজেট বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি। বৈঠকে অর্থপ্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়সা খান উপস্থিত ছিলেন।
এমপিদের গাড়ি ছাড়া আর যেসব বিষয়ে সিদ্বান্ত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়াছে না । নিত্যপণ্যের আমদানি কর বাতিল করা হচ্ছে। ক্যাপিটাল গেইন সুবিধা সীমিত করা হচ্ছে।
তবে অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এনবিআর কখনোই টানা করমুক্ত আয়ের সীমা কমায়নি। সাধারণত ২-৩ বছর বিরতিতে আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। ২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ২০ লাখ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়।
নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক একেবারে শূন্য করা হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়নি বৈঠকে। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুবিধা চাল আমদানিকারকরা পাবেন আগামী ১৫ মে পর্যন্ত। এ সুবিধা পেতে আমদানির প্রতিটি চালানের বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার লিখিত অনুমোদন লাগবে।
দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। এ সুবিধা তারা পাবেন আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট কমানো হয়েছে। আমদানিকারকেরা এ সুবিধা পাবেন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত।
খেজুর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। বর্তমানে খেজুর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ। তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুবিধা আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত।
এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির বিষয়ে বৈঠক সূত্র জানায়, এনবিআরের প্রস্তাবে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাব নিয়ে এখনো পক্ষে-বিপক্ষে মত দেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এরই মধ্যে সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এনবিআরের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একাধিক ব্যক্তির কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের আমদানি করা গাড়ির অধিকাংশই উচ্চমূল্যের, বিলাসবহুল। অধিকাংশ সংসদ সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় জাপানের টয়োটা, ল্যান্ড ক্রুজার, স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের প্রাডো টিএক্স ও ডিজেলচালিত ভিএক্স মডেলের গাড়ি আমদানি করেছেন। এছাড়া উচ্চমূল্যের অন্য ব্র্যান্ডের গাড়িও আমদানি করেছেন তারা।
সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করায় সরকারের এক মেয়াদে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়। সে হিসাবে এ পর্যন্ত এনবিআর গড়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম পেয়েছে। এক/এগারো-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ সুবিধা স্থগিত করা হয়। ২০১০ সালের ২৯ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে সুবিধা পুনর্বহাল করে। সংসদ সদস্য হিসেবে ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদ হলেই শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুযোগ পান তখন থেকে। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া নতুন আইন অনুযায়ী এক দিনের সংসদ সদস্যও শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনতে পারবেন।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের তৈরি বিলাসবহুল ওইসব গাড়ির মূল্য ৫০ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকা বা তারও বেশি। শুল্ককর হিসেবে এসব গাড়ি আমদানিতে এনবিআরের আইনানুযায়ী ক্রয়মূল্যের ৮ থেকে ১০ গুণ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা। সে হিসাবে এসব গাড়ির প্রতিটি থেকে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা শুল্ককর আসে।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যে সরকারই ক্ষমতায় আসে তারাই শুল্কমুক্ত সুবিধায় সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানে এনবিআরের কিছু করার থাকে না। এবার আইএমএফের সুপারিশে এনবিআর থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুবিধা কমানো হয়েছে। যেহেতু আইএমএফের শর্তে আছে, এবার প্রভাবশালীদের দাপটে এ প্রস্তাব বাতিল হবে না আশা করা যায়।