ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নির্বাচনী ইশতেহারে ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস। সবচেয়ে অগ্রাধিকার ছিল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও যানজট দূর করে মানবিক রাজধানী গড়ে তোলার। কিন্তু মেয়াদের চার বছরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া বলার মতো অগ্রগতি হয়েছে আদি বুড়িগঙ্গা নদীর পানি প্রবাহে প্রাণ ফেরানো। বাকি সব প্রতিশ্রুতিই সার। একটু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নাকাল করছে। যানজটে নাগরিকদের নিত্য নাভিশ্বাস উঠছে। বাগে আসেনি ডেঙ্গু, কাড়ছে প্রাণ।
নগর গবেষকরা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মেয়রদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্যে, দুই সিটিতে মেয়রদের ৮৮ প্রতিশ্রুতির এক-তৃতীয়াংশও বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ভোটের রাজনীতির কারণে এমন সব প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন, যেগুলোতে এখতিয়ারই নেই মেয়রদের। আবার পদ্ধতিগত ত্রুটি কারণেও অনেক উদ্যোগে আসেনি সফলতা।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়র হিসেবে শপথ নেন। এর পর ১৩ মে ঢাকা উত্তরের দায়িত্ব নেন আতিকুল ইসলাম এবং ১৬ মে ঢাকা দক্ষিণের চেয়ারে বসেন শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচন ঘিরে ১ ফেব্রুয়ারি আতিকুল ইসলাম ইশতেহারে ৩৮ ও তাপস ৫০টি প্রতিশ্রুতি দেন।
দুই মেয়রই মশাকে বশে আনতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকারি হিসাবেই গত বছর রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৮০ জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন। চলতি বছর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮ ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৮৮ জন।
দুই মেয়রের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকা শহর। দক্ষিণের অবস্থা ছিল ঢাকা উত্তরের চেয়ে ভয়াবহ।
অবশ্য দুই মেয়র কোরবানি পশুর বর্জ্য অপসারণে সাফল্য দেখিয়েছেন। প্রতিবছরই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়েছে। ঈদুল আজহার পরদিনই কোরবানির বর্জ্য অপসারণ করে নগরবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকার দৃশ্য খুবই কম। যদিও বর্জ্যবাহী গাড়ির চাপায় একের পর প্রাণহানি সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দক্ষিণের মেয়র ঢাকা গেট ও লালকুঠির কাজ দৃশ্যমান করেছেন। মানবিক নানা কর্মসূচিতে সাফল্য দেখিয়েছেন। ঢাকার মানুষ বুড়িগঙ্গাকে জীবিত দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তাপসের উদ্যোগে আদি বুড়িগঙ্গায় ফিরেছে প্রাণ।
ইশতেহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস পাঁচ দফায় ৫০ বিষয়ে উন্নয়ন, সংস্কার ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেও মাত্র ১৫টিতে কাজ শুরু করতে পেরেছেন। অন্যদিকে, ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ৩৮টি প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজ শুরু করেছেন হাতেগোনা কয়েকটিতে।
যানজট নিরসন
চার বছরে রাজধানীর যানজট কমার বদলে বেড়েছে। যানজট নিরসনে উত্তরের মেয়র সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, নিরাপদ পথচারী পারাপারে ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল স্থাপন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বাস চালু, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকের জন্য গণস্থাপনা ও গণপরিবহন, ইলেকট্রিক বাস চালুর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন দূরে থাক, শুরুই করতে পারেননি।
দক্ষিণের মেয়র গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গতিভিত্তিক সড়ক নির্দিষ্টকরণ, শুধু হাঁটার জন্য রাস্তা করে নিরাপদ সড়কসহ নগর ঘুরে দেখার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিলেও কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি দুই মেয়রের যৌথ উদ্যোগে বাস রুট রেশনালাইজেশন নগরবাসীর মধ্যে সাড়া ফেললেও মাস কয়েক পরই থমকে যায়।
বায়ু ও শব্দদূষণ বেড়েছে
গত কয়েক বছর ধরে রাজধানী শহর বায়ু ও শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি দুই মেয়র। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শব্দ ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কার্যকর হয়নি।
রাজধানীতে খেলার মাঠ ও পার্ক খুবই কম। ডিএনসিসির ১০ ও ডিএসসিসির ৩১ ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। বিদ্যমান মাঠগুলোর কয়েকটি রাজনৈতিক শক্তি, জনপ্রতিনিধি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দখলে রেখেছে। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ডিএসসিসির শিশু পার্ক বন্ধ রয়েছে। দখলমুক্ত হয়নি বেশির ভাগ ফুটপাত। অবৈধ দোকানপাট ও হকারদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলে সারাবছর। এতে দুর্ভোগ পোহান নগরবাসী। অবশ্য মেয়াদকালে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছেন দুই মেয়রই।
নগর গবেষকদের মূল্যায়ন
নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, মেয়ররা যেসব প্রতিশ্রুতি দেন, তা চার বছরে বাস্তবায়ন কঠিন। মূলত মানুষকে শোনানোর জন্য তারা এটি করেন। সাধারণ মানুষ কী চান, মেয়ররা ভালো করেই জানেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের জনবল, অর্থবল, প্রযুক্তি ও কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। মেয়ররা এমন সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেগুলো পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, নিজেরাই জানেন। ফলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মেয়রদের উদ্দেশ্য সৎ কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে কিছু খাল দীর্ঘদিন পর মেয়ররা দখলমুক্ত করেছেন, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দুই মেয়র কিছু মাঠ ও পার্ক উদ্ধার করেছেন। তবে এগুলো বাণিজ্যিকীকরণ ও ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারেন না। ডিএনসিসিতে নতুন ওয়ার্ড মাস্টারপ্ল্যান করলেও বাস্তবায়নের গতি ধীর। অন্যদিকে, ডিএসসিসির ওয়ার্ডভিত্তিক মাস্টারপ্ল্যান শুরু করলেও চার বছরে শেষ হয়নি। দুই মেয়র ঢাকা নগর পরিবহন চালু করতে বাস মালিকদের সঙ্গে অনেক মিটিং করলেও, সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম চার বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পাড়া-মহল্লা, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। গত বছর ঠিকাদারের প্রতারণার কারণে ন্যাচারাল বেজড সলিউশন বিটিআই ব্যবহার শুরু করতে পারেনি। এ বছর নিজেরা বিটিআই আমদানি করব। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প শুরু হয়েছে। মেয়াদের শেষ বছরের প্রধান কাজ হবে সব খাল উদ্ধার করা।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, সঠিক যত্ন না পাওয়ায় ডেঙ্গুতে এত মানুষ মারা গেছে। যদিও ঢালাওভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের যে তথ্য রাজধানীতে দেওয়া হয়, তা সঠিক না। এখন আর রাস্তায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে না। অন্য বিষয়গুলোও ধাপে ধাপে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিয়ে সমাধান করতে হবে।