ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ টি২০ বিশ্বকাপ দলে যে তেমন চমক থাকবে না, তা সবারই জানা ছিল। নির্বাচক প্যানেলের দুই সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ও হান্নান সরকারকে পাশে নিয়ে প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু কোনো চমক দেননি। তবে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে গতকাল ১৫ সদস্যের যে দল ঘোষণা করেছেন, তাতে চমকের জায়গায় উপেক্ষার বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছে। অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে বিশ্বকাপ দলে না রাখাকে বলা হচ্ছে উপেক্ষা। দল ঘোষণার ৩৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ অংশে তাই থাকলেন সাইফউদ্দিন। তাঁকে বিশ্বকাপ দলে রাখা-না রাখার বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয় প্রধান নির্বাচককে। বিশ্বকাপ দলের বাকি ১৪ জনের মধ্যে থাকা তাসকিন আহমেদের চোট আর সহঅধিনায়ক মনোনীত হওয়ার বিষয়টি ছাড়া তেমন কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি লিপুকে। এ বিবেচনায় বিসিবির সাবেক প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর দৃষ্টিতে টি২০ বিশ্বকাপ দল ভালো হয়েছে। তবে সাইফউদ্দিন থাকলে দল আরও ভালো হতো বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।
বিপিএল পারফরম্যান্স ও জাতীয় দলের সিরিজ বিবেচনায় নিলে সাইফউদ্দিন অলরাউন্ডার কোটায় বিশ্বকাপ দলে থাকার দাবিদার। অভিজ্ঞতাও পেস বোলিং এ অলরাউন্ডারের পক্ষে ছিল। ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০২১ সালের টি২০ বিশ্বকাপ খেলা ডানহাতি এ অলরাউন্ডারকে দলে রেখেওছিলেন নির্বাচকরা। লিপু জানান, ৩০ এপ্রিল আইসিসিকে দেওয়া ১৫ জনে ছিলেন সাইফউদ্দিন। তাঁকে শেষ মুহূর্তে বাদ দেওয়ার কারণ তাসকিনের ইনজুরি। পাঁজরের হাড়ের চোট ও পেশির টান থেকে তাঁর সেরে উঠতে তিন থেকে চার সপ্তাহ লেগে যেতে পারে বলে জানান বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী।
সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ খেলা হবে না তাঁর। এ সময়ে তাসকিনের বিকল্প হিসেবে খেলানো হতে পারে তানজিম সাকিবকে। এ কারণে সোমবার সন্ধ্যায় শেষ মুহূর্তের পরিবর্তনে সাইফউদ্দিনের বাদ পড়া। যদিও লিপুর ব্যাখ্যা ভিন্ন, ‘তানজিমকে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও আমরা দেখেছি। তার একাগ্রতা, মাঠে দেওয়ার চেষ্টা সাইফউদ্দিনের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। আমরা যে কারণে সাইফউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম– ডেথ ওভারে ইয়র্কার করা, সেটা ঘরোয়া ক্রিকেটে যেমন ছিল তার চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। তাই আমরা ভিন্ন চিন্তা করেছি। ৩০ তারিখে যে দলটা দিয়েছিলাম, সেখান থেকে একমাত্র এ জায়গাতেই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের মধ্যে সাইফউদ্দিন ও তানজিমকে নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল।’
নির্বাচকরা বিশ্বকাপ দল সাজিয়েছিলেন চারজন করে পেসার ও স্পিনার দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশন বিবেচনায় এ কৌশল বলে জানান লিপু। যেখানে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে আছেন দ্বিতীয় বাঁহাতি স্পিনার তানভির ইসলাম। মূলত নেদারল্যান্ডস ও নেপালের বিপক্ষে অনুষ্ঠেয় ম্যাচ দুটির কথা মাথায় রেখে দ্বিতীয় বাঁহাতি স্পিনার নেওয়া। নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক জানান, এশিয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশনে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন স্পিনারররা। তাঁর বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়ায় ড্রপ-ইন পিচে স্পিনারদের জন্য সুবিধা থাকবে। চারজন পেস বোলার নেওয়ার পেছনেও কন্ডিশনের ভূমিকা বেশি। পঞ্চম পেসারের অভাব পূরণে ভরসা সৌম্য সরকার। তাঁর একাদশে থাকা মানে একজন বাড়তি পেসার পাওয়া। বোলিং নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা না থাকলেও ব্যাটারদের ফর্ম ভাবাচ্ছে নির্বাচকদের। বিশেষ করে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ টি২০ সিরিজের নাজমুল হোসেন শান্ত ও লিটন কুমার দাসের রান না পাওয়া। টানা ছন্দহীন লিটনকে দলে নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে লিপু বলেন, ‘লিটনকে যে ম্যাচে যুক্ত করতে পারিনি, সেটি সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ ছিল। তাঁকে নেওয়ার ক্ষেত্রে একজন ওপেনারের সঙ্গে উইকেটকিপিংটাও চিন্তা করতে হয়েছে। তাই ফর্মের ঘাটতির পরও লিটনের ওপর আস্থা রেখেছি। বল সিলেকশন ও শট সিলেকশনের ক্ষেত্রে লিটনকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’
বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া সব ক্রিকেটারই পুরোনো। সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠেয় এবারের টি২০ বিশ্বকাপে ভালো ফল আশা করেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, ‘এই দলটি অভিজ্ঞ, অনেক দিন ধরে একসঙ্গে খেলছে। ১৫ জনের স্কোয়াডে একেবারে নতুন কেউ নেই। সেদিক থেকে বলব বিশ্বকাপ দল ভালো হয়েছে। কন্ডিশন বিবেচনায় এবার ভালো করা উচিত। তবে আমি মনে করি অতিরিক্ত দু’জনের জায়গায় তিনজন নিতে পারত। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত লিগে অনেক ভালো খেলেছে। কেউ চোটে পড়লে তার বিকল্প হতে পারত সে।’
বিশ্বকাপের পর বিশ্বকাপ গেলেও বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না। সেই ২০০৮ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোই রেকর্ড। বাকি সাত টি২০ বিশ্বকাপের সেরা পারফরম্যান্স ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়েকে হারানো। সাকিবের দৃষ্টিতে যেটা টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। গতকাল ঘোষিত দলের কাছে নির্বাচকদের প্রত্যাশা কী, জানতে চাওয়া হলে লিপুর বিশ্লষণ ছিল, ‘প্রথম ম্যাচে দুটো (বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা) দলই বিশ্বাস করে একে অন্যকে হারাতে পারে। এটা খুব চাপের ম্যাচ হবে। সেটা জিতলে পরের তিন ম্যাচের দুটো ম্যাচে জেতার খুব সম্ভাবনা দেখছি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে হারানো যাবে না, তা নয়। অবশ্যই আমাদের সঙ্গে ওদের ব্যবধান আছে। তবে তাদের বিলো পারফর্ম বা আমাদের ওভার পারফর্ম করে ওদের হারাতে হবে।’ প্রধান নির্বাচকের মতো প্রতিপক্ষকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা না দিলেও নাজমুল আবেদীন ফাহিম জানান, বিশ্বকাপে ভালো খেলা নির্ভর করবে দল হিসেবে গড়ে ওঠার বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘এই দলটিকে এখন পাজল্ড-এর সঙ্গে তুলনা করব। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ ও অনুশীলন দিয়ে এক সুতোয় বাঁধা গেলে ভালো করার সুযোগ থাকবে। কতটা ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে, সেটাই বড় কথা।’ বিকেএসপির সাবেক এ ক্রিকেট উপদেষ্টা মনে করেন, দল গঠনে বড় ভুল হয়েছে সাইফউদ্দিনকে বাদ দেওয়া। তাঁর মতে, লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনকে অলরাউন্ডার বিবেচনা করা ভুল হচ্ছে। এ ধারণা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন তিনি। ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগের ভারসাম্য রাখতে সাইফউদ্দিনের প্রয়োজন ছিল বলে দাবি তাঁর।