DMCA.com Protection Status
title="৭

রাজনৈতিক নির্যাতনের ধরন উদ্বেগজনক, জাতীয় জীবনে গুরুতর পরিণতির আশঙ্কা

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গত বছর ২৮ অক্টোবর। আমরা সকলেই এমন এক নিন্দনীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম যেখানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একটি শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশকে ব্যর্থ করার জন্য দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র নৃশংস শক্তি প্রয়োগ করল। সহিংসতার পরবর্তী উদাহরণ দলীয় নেতাকর্মী ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু।

বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বেশিরভাগ উদ্যোগই পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর ঘটনার পর সারাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের ধরন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সহিংস এবং মানবিক মর্যাদাবর্জিত। বেশ কিছু তৃণমূল নেতাকর্মীকে পুলিশ হেফাজতেও নির্যাতন করা হয়। তাদের কর্মকাণ্ড মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ভয়ঙ্কর নমুনা প্রকাশ করে।

নুর মোহাম্মদ সুমন। ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া অসংখ্য নেতাকর্মীদের একজন। তিনি যেভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার ভাষায়, ‘আমাকে ২৮ অক্টোবর মিন্টু রোডে গোয়েন্দা শাখার অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। চার-পাঁচজন আমাকে প্লাস্টিকের লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল। তাদের মুখ ঢাকা ছিল।’ সুমন চট্টগ্রাম সিটি ইউনিটের চকবাজার থানা সেচ্ছাসেবক দলের (বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক শাখা) সদস্য। তিনি নয়াপল্টনের বিশাল জনসভায় যোগদানের স্বপ্নে উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি শিগগিরই তার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

সুমন বলেন, দলীয় নেতাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত করার জন্য তাকে ১৬৪ ধারায় (স্বীকারোক্তিমূলক) বিবৃতি দিতে বলা হয়েছিল, যা তিনি চাপের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অবিরাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরদিন তাকে আদালতে তোলা হয়। ভোগান্তি বাড়াতে আদালতের নির্দেশে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

উপরন্তু, তিনি নির্যাতনে আহত হওয়ায় চিকিৎসার জন্য ৬ দিন হাসপাতালে ছিলেন। সুমন বলেন, ‘আমাকে ডিবি তুলে নেওয়ার সময় আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর ফোনটি আর ফেরত দেয়নি।’

চট্রগ্রামের মোস্তফা হাকিম কলেজের ছাত্রদলের (বিএনপির ছাত্রসংগঠন) সিনিয়র যুগ্ম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল গণির কথা ধরা যাক। গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিটি গেট এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ‘আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাথে সাথে আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়,’ গণি বলেছেন। কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তার কোনো কারণ তাকে বলা হয়নি। ‘আমাকে সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাঠি দিয়ে মারধর করা হয়। আমাকে অপদস্থ করার জন্য ডিউটি অফিসার আমাকে থাপ্পড় মারে, মারধর করে,’ গণি বলেন। গণি বা সুমন কাউকেই গ্রেফতারের কারণ বা তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার কারণ বলা হয়নি।

নেসার আহমেদ ও আবির সাহাদত। দুইজনই ২৯ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে চট্টগ্রাম শহরের কর্নেল হাট এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। আকবর শাহ থানার তাঁতীদলের (বিএনপির তাঁতি শাখা) সম্পাদক নেসার এবং আবির চট্টগ্রাম সিটি ইউনিটের একই থানার সেচ্ছাসেবক দলের (স্বেচ্ছাসেবক শাখা) সদস্য।

তাকে কিভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল?

নেসারের বর্ণনায়, ‘গ্রেপ্তার করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার হাতে ক্রমাগত মার খেয়েছি। আমাকে যখন হাতকড়া পরানো হচ্ছিল তখন তারা আমাকে মারতে থাকে। এতে আমার হাতের কব্জি ও ডান হাঁটু ভেঙে যায়। পুলিশ ভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময়ও আমাকে ক্রমাগত থাপ্পড় মারছিল। একপর্যায়ে আমি চিকিৎসা ও পানির জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা মোটেও আমলে নেয়নি।’

নেসার যখন এসব বলছিলেন তখনও তার শরীরে প্রচণ্ড মারধরের চিহ্ন ছিল। মানসিক ক্ষত ছিল আরও গভীর। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ছাপ ছিল যে কিভাবে তিনি নির্যাতন সহ্য করেছেন। এবং তাকে অপমান হজম করতে হয়েছে। কেবল বিরোধী দলের কর্মী হওয়ার জন্য। বিরোধী দলের রাজনীতি করায় সত্যিই তাকে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়েছে।

আবিরকে গ্রেফতারের সময়ও একইভাবে, বেধড়ক মারধর করা হয়। আবিরের ভাষায়, ‘তারা আমাকে তাড়া করল। তারা আমাকে ধরে ফেলল। তারা আমাকে নির্মমভাবে মারধর করে। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর তারা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় এমনভাবে ভ্যানের ওপর আছড়ে ফেলে যে, আমার নাক ভেঙে যায়।’ নেসার দেখেছিলেন সেই দৃশ্য। নেসার সাক্ষ্য দেন, ‘আমি আবিরকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখি। আবিরের মুখ থেকে ফেনা বের হতে দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তাকে মারধর বন্ধ করতে এবং তাকে অবিলম্বে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।’

সুমন ও গণির মতোই অবৈধভাবে আবির ও নেসারের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, যা আর ফেরত দেওয়া হয়নি।

এই চার নেতার ক্ষেত্রেই অবৈধ গ্রেপ্তারের সাধারণ ক্রম অনুসরণ করে মোবাইল ফোনগুলো জোরপূর্বক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং হেফাজতে নির্যাতনের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া চারটি ঘটনায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করা হয়েছে হেফাজতে নেওয়ার পর। মৌলিক মানবাধিকার এবং আইনগত অধিকার এই প্রতিটি ক্ষেত্রে একাধিক স্তরে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এ ধরনের নির্মমতা এবং হিংস্রতা প্রমাণ করে রাষ্ট্রযন্ত্র ভিন্নমত দমন করতে এবং ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করতে কতদূর যেতে পারে। মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন ২০১৩ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিত করে বলা যায়, আমরা এই আইন শিগগিরই কার্যকর হতে দেখব না। বিচারিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা এই ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, যা বিশেষভাবে নাগরিকদের মধ্যে প্রচার করা হয় ভীতি সঞ্চার করার জন্য।

যতদিন এই ব্যবস্থা থাকবে ততদিন বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের মান কমতে থাকবে।

অত্যাচার শুধু শারীরিক যন্ত্রণা দেয় না, এটি মানসিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতাও দেয়, যা একজন মানুষ সারাজীবন বহন করে। যাইহোক, আরও মারাত্মকভাবে, নির্যাতনের শাস্তি থেকে দায়মুক্তি অসন্তোষের দুষ্টচক্র তৈরি করছে, যা প্রশমিত না হলে আমাদের সমাজকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করবে এবং সোনার বাংলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!