ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের আওতাধীন অন্তত ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে শুল্ককর বাবদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ১৩ শতাংশের বেশি। অথচ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের পাশাপাশি বর্তমান সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এমন বাস্তবতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অংশ হিসেবে এ বকেয়া কর আদায়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকা বাজেটে বরাদ্দের অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি এনবিআরকে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্তও হয়েছে।
জানা গেছে, গত সোমবার রাজস্ব ভবনের সম্মেলন কক্ষে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে এ খাতের বকেয়া কর আদায়ে উপায় নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এনবিআরের সদস্য, বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান, বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জটিলতা নিরসন করে দ্রুত এসব বকেয়া রাজস্ব আদায়ে সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আগামী বাজেটে ‘বুক অ্যাডজাস্টমেন্ট’ পদ্ধতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব করখেলাপি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দেওয়া বরাদ্দ থেকে সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কর্তনের মাধ্যমে অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা আদায়ে নীতগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত হবে।
বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর বাবদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপিসির বকেয়া কর ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি, তিতাস গ্যাসের ২ হাজার ২৮৪ কোটি, পদ্মা ওয়েলের ২ হাজার ১৪৫ কোটি, সিলেট গ্যাসের ১ হাজার ৭৩৫ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১ হাজার ২৮ কোটি টাকাসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কর বকেয়া রয়েছে।
সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা, বিপিসিসহ এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে ২৪ হাজার ২২১ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করলেও তা এনবিআরে জমা দেয়নি। এ ছাড়া আয়কর বাবদ ১৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা এবং আমদান শুল্ক বাবদ ১৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও এনবিআরকে দেয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট বকেয়া শুল্ককর ৫৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং অর্থ বিভাগকে সব বকেয়া আদায়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেন। এর পর চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল ‘বুক অ্যাডজাস্টমেন্ট’ পদ্ধতিতে সমন্বয় নিয়ে জ্বালানি সচিব মো. নুরুল আলমের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা
অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুয়ায়ী, আগামী অর্থবছর সরকারকে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করতে হবে। রাজস্বের প্রায় পুরোটাই আদায় করে এনবিআর। প্রথামিক হিসাব অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করতে হবে। জ্বালানি খাতের বকেয়া করের ৫৫ হাজার কোটি টাকা পেলে এ শর্ত পূরণ অনেকটাই সহজ হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানের কর খেলাপির কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সমস্যা দেখা দেয়। এ ধরনের নানা কারণে কর-ডিজিপির অনুপাতও বাড়ে না। বহুদিন থেকে এ অবস্থা বিদ্যমান। এসব প্রতিষ্ঠান যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে কর দিত, তাহলে সরকারকে এত বেশি ঋণ নিতে হতো না। তাই সরকারকে নিজের স্বার্থে এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে আয় বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি লভ্যাংশ পাওয়া গেলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কমবে। জনগণের ওপরও করের বোঝা কমার সুযোগ আসবে। এ বিষয়গুলোতে আরও নজর দিতে হবে।